মুনিয়া
এবারের পুজো- রিনি ঘোষ এবার টা ঠাকুর দেখা সত্যিই আর হয়ে উঠল না। কলকাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উধাও ছিল। কোথাও তালটা কেটে গেছিল। ছেলে মেয়েগুলো না খেয়ে বসে আছে আজ নিয়ে ন’দিন ।এক এক করে হসপিটালে গ্রিন করিডর দিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদেরও তো পুজো ছিল? দুজনের তো বিয়ের পর প্রথম পুজো ছিল- দেবাশিস আর স্নিগ্ধা । বারবার ওদের কথা ভাবনাতে চলে আসছিল। বিয়ের পর আমার প্রথম পুজোয় প্রেগনেন্ট ছিলাম তাই পারমিশন ছিল শুধু দূর থেকে দেখার। দ্বিতীয় পুজো বন্দী হয়ে ছেলে কোলে একা ঘরে কাটিয়েছি। কেউ ছিল না ।সবাই আমায় বাদ দিয়ে দিল।তৃতীয় পুজো কেদারনাথ বদ্রীনাথ গেছিলাম। ওখানেই পুজো দিয়ে মনকে আবার আগের জায়গাতে ফেরত পাই। বিশাল শিবে মাথাটা ঠুকে গেছিল কিন্তু মনে হল সব ক্লান্তির শেষ হল। প্রদীপ ভাসালাম আর ফিরেই মেয়ের আসার খবর পেলাম। আমার জীবনের নতুন আশায় আবার বুক বাঁধলাম। তারপর আনন্দ ই আনন্দ। ওর দিকে তাকিয়ে সব ভুলে জীবনে এগিয়ে চলেছি….।
মুনিয়া
এক্ষুণি পিজা দেখে ফিরলাম। পিজা কি বুঝলেন না? আরে পিসা টাওয়ার। সকালে উঠে দুই মাইল হেঁটে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গাছের তলার বুথে চেক ইন করার পর গাইড মেয়েটি লম্বা ফ্ল্যাগ উঁচিয়ে গলা তুলে বললো, নীল স্টিকারের লোকেরা, আমার পিছু পিছু এস পিজার লাইনে, আর আমি মাথা চুলকিয়ে ভাবছি এই সাতসকালে পিৎজা খেয়ে বাসে উঠলে যদি বমি হয়ে যায়!? খানিক পরে বুঝলুম ছোটবেলা থেকে যে বলে আসছি, পিসার টাওয়ারের মত হেলে আছ কেন, সে বাক্যটিত আসল শব্দটিই ভুল। এই অবেলায় এদিকপানে না এলে কোটি কোটি ভুল জানাবোঝার সাথে এটিও যুক্ত করে পৃথিবী ছাড়তে হত। তার আগে কি যেন বলছিলাম, হ্যাঁ, ভেনিসে গাইড ভদ্রলোক দু:খ করছিলেন সেখানকার ক্রমাগত কমতে থাকা জনসংখ্যার নিম্নগতিপ্রকৃতিতে। প্রতি বছর ভেনিস প্রায় এক হাজার করে লোকসংখ্যা হারাতে থাকে। ১৯৫১ তে মোট জনসংখ্যা ১৫০ হাজার থেকে আজ সেই সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের নীচে নেমে এসেছে।ভদ্রলোক আলগাভাবে পর্যটকদের এইকারণে দায়ি করলেন। বলছিলেন,পর্যটকরা এত বেশি মূল্যে এয়ারবিএনবি ভাড়া নিতে স্বচ্ছন্দ যে আদিবাসীরা নিজেদের লোকের বদলে বেশি পয়সার চাহিদায় বিদেশীদের বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে। তাই লোকাল লোকেরা বাড়ি ভাড়া নিতে চেয়েও পর্যটকদের সাথে দরে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছেনা, নিজেদের জায়গা ছেড়ে অন্য শহর, দেশে পাড়ি দিচ্ছে। ভদ্রলোকের যুক্তি সঠিক হলেও পর্যটকেরা হয়ত এই ক্ষেত্রে দুধারি তরবারির কাজ করছে। কারণ বাসিন্দাদের সকলে তো ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ নয়। ধরে নিলাম পর্যটকদের ব্যান করা হল। তাহলে ৮০ ইউরো দিয়ে গন্ডোলা কারা চড়বে? আজকেই জানতে পারলাম কুড়ি ইউরো দিয়ে পুরো একদিন ভেনিসের নানা দ্বীপে ঘুরে বেড়াবার পাস কেনা যায়। একদিনের টিকিটে সতেরোশো টাকা খরচা করবে কারা? কয়েক হাজার ইউরো দিয়ে মুরানোর কাচের ফুলদানি কে কিনবে? আর বুরানোর হাতে বোনা লেসের টেবিল ক্লথও তো টাকার বস্তা দিয়ে স্থানীয় মানুষ কিনবে না। পর্যটক, পরিদর্শক কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এমন সব পৃথিবী বিখ্যাত( বেশিটাই হাইপ) জায়গাগুলির ছোট বড় ব্যবসায়ীদের যে কি যে হাল হয় ২০১৯ এর বন্যা এবং ৬৯ দিনের কোভিড ১৯ ই লকডাউনই তা প্রমাণ করে দিয়েছিল যখন ভেনিস তিন মাসে ৮০০ মিলিয়ান ইউরো হারিয়েছিল আর হোটেলগুলির ৭০ শতাংশ রিজার্ভেশন বাতিল হয়েছিল। আমাদের গাইড ভদ্রলোক বললেন, পর্যটক না থাকায় বাধ্য হয়ে তিনি শিক্ষাকতা শুরু করেছিলেন। বললেন, কখনো হাই স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে ডিল করেছ? তারপর আতঙ্কিত মুখে দুই হাত নেড়ে বললেন ওইপথে আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই! বুঝুন কান্ড! শিক্ষাকতার চাকরি দেশে বিদেশে কত সম্মানীয় বলে গণ্য হয়। পয়সা, সুবিধে কিছু কম নয় শিক্ষাকতায়। সে চাকরি না করে পায়ে হেঁটে ছয় ঘন্টা ধরে যিনি ভেনিস দেখানো শ্রেয় মনে করেন তিনি হয় মহা প্যাশনেট নয় ছাত্র ছাত্রীদের দ্বারা অতীব অত্যাচারিত। সঠিক কারণ কি জানবার চেষ্টা করলাম না। মানে লজ্জা হল জিজ্ঞেস করতে কিন্তু আমার না কোনো মিউজিয়াম, প্রসিদ্ধ স্থান দেখার থেকে মানুষদের গল্প জানতে আরো ভালো লাগে। হোটেলে থাকার থেকে স্থানীয় লোকেদের সাথে থেকে তাঁদের রোজকার দৈনন্দিন জীবনধারণ, কালচারের কথা আরো আগ্রহজনক মনে হয়। রুগি দেখার ফাঁকে একটু সময় বার করে যে মহিলা আকাশপানে চেয়ে একমনে ধূমপান করেন, তিনি তক্ষুণি কি ভাবছেন জানতে ইচ্ছে করে অথবা যে বাংলাদেশি ছেলেটি, বাড়ি থেকে এতদূরে পাড়ি দিয়ে চারিপাশের দেশি বিদেশি দোকানদারদের সাথে গা ঘেঁষাঘেষি করে তাঁদের মত একই টাইপের দোকান খুলে দিনের শেষে সত্যিই কি লাভের মুখ দেখে, মনে হয় জিজ্ঞেস করি তাকে। অথবা রোমের শপিং মলের শেডের তলায় সকাল এগারোটায় একের পর এক শুয়ে থাকা নিজের দেশ থেকে পালিয়ে আসা জীবন্ত লাশেরা? কেউ কেউ একটু পাঁউরুটি জল কিনে যাঁদের মাথার কাছে দিয়ে যায়, আফ্রিকার কোনো শহর নিজের মানুষগুলিকে কি এর থেকে বেশি সম্মান দিতে পারেনি?
জল
ঘুম সকাল সকালই ভাঙল| তবু বিছানা কামড়ে পড়ে রইলাম| আজ যেন কম্বলের বাইরে বের হতেই ইচ্ছে হচ্ছে না| মোবাইলে তখন তাপমাত্রা ৭ দেখাচ্ছে| ৯ টায় চেক আউট টাইম| একটু বেলা করেই উঠলাম| বেড টি যখন দিল তখন আমার ব্রাশ করা হয়ে গেছে| দীপঙ্কর স্নান করতে গেছে| গুল্লুকে তুলে দিলাম| সত্যি আজ কি ঠান্ডা রে বাবা| তৈরী হতে না হতেই রুম সার্ভিস এসে বলে গেল ঘর ছাড়ার কথা| আমরা লাগেজ নিয়ে লনে চলে এলাম| উন্মুক্ত রোদে পিঠ দিয়ে সবাই গল্প করছে| আজ আর প্রাতরাশ নেই| সরাসরি লাঞ্চ| দশটায় খেতে ডাকবে| সবার মন খারাপ| এই দুদিনে কারও মন পোষালো না| সবার সেই এক কথা আবার ফিরে গিয়ে সংসারে যূতে যেতে হবে| বাচ্চাগুলো দোলনায় দুলছে‚ খেলছে| এখানে বেশ কটা কুকুরের বাচ্চা| সেগুলো কদিন ধরেই পায়ে পায়ে ঘুরেছে| ওদের প্রতি মায়া জন্মে গেছে| ওরাও বুঝি বুঝে গেছে আমরা চলে যাচ্ছি| তাই আজ আর পায়ে পায়ে ঘুরছে না| আমাদের বাচ্চাগুলোর সাথে খেলছেও না| জঙ্গলে ছাগলছানার সাথে আজ ওরা খেলছে| তাই আমাদের বাচ্চাদের মনখারাপ| দশটায় পাত পড়ল| খেতে বসে গেল একদল| সবার তো একসাথে হবেও না| একদল খেয়ে ওঠার পর আমরা খেতে বসলাম| গরম গরম ভাত‚ ডাল‚ বেগুনভাজা‚ বাগানের সীম দিয়ে আলুর একটা তরকারি আর ডিমের কালিয়া| সীম দিয়ে আলু দিয়ে যে এত চমৎকার তরকারী হয়ে আগে জানতাম না| সীম আমার প্রিয় সব্জিও নয়| দুবার চেয়ে খেলাম| আজ এরা এতটা ভাত দিয়েছে কেন? সবার পাতেই ভাত পড়ে রইল| নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না‚ জিনিসের এত দাম| কিন্তু তবু না চাইতেও নষ্ট হয়| আমরা খেয়ে দেয়ে আরও একটু রোদ পুইয়ে নি| এখানে রোদ উদাত্ত| গায়ে আর সোয়েটার রাখা দায়| বাস ছাড়ে প্রায় সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা নাগাদ| পাহাড় থেকে ক্রমাগত সমতলের দিকে নামছি আমরা| পুরুলিয়া শহরাঞ্চলে শপিংমল থেকে‚ প্যান্টালুনস সবই আছে| ক্ষণিকের ভ্রম হয় আমরা নিজেদের জায়গাতেই চলে এসেছি| আবার শহর ছেড়ে গ্রামের পথে চলি আমরা| মাঠে মাঠে সরষের চাষে হলুদ হয়ে আছে| একজায়গায় প্রচুর লোকের ভিড়| জানলাম সেটা সাপ্তাহিক হাট| বাস এগিয়ে চলল |অনেকেরই চা তেষ্টা পেয়েছে‚ কারও কারও টয়লেট| একটা ধাবা মত জায়গায় বাস দাঁড়ালো| টয়লেট সেই পিছনে পুকুরপাড়ে| পুকুরে প্রচুর রক্তপলাশ| এসব আমি চিনি না| ওঁনারাই বললেন| চুপি চুপি বলে রাখি আমি তো ভেবেছিলাম ওগুলো জলপদ্ম| বলিনি কাউকে‚ তাহলে তো ভাববে এ মেয়ে দেখো কিছুই জানে না| যাইহোক‚ সে টয়লেট দেখেই চিত্তির| তবু যেতে হল| আবার বাস চলল| আমাদের গন্তব্য জয়রামবাটি-কামারপুকুর| বাঁকুড়ায় কখন ঢুকে পড়েছি খেয়াল হয়নি| মোটামুটি সকলেরই খিদে পেয়েছে| আমরা সম্গে করে বিস্কুট‚ মুড়ি‚ চানাচুর‚ কেক এনেছি| তাই সবাই মিলে শেয়ার করে খাওয়া| এও এক মজা| বাস প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ জয়রামবাটিতে পৌঁছাল| সবার জন্য চা আর সিঙারা| খেয়ে দেয়ে আমরা সারদা মায়ের জন্মস্থানের দিকে এগিয়ে যাই| বেশ ভিড়| সাজানো-গোছানো| সবে মাত্র স্বামী বিবেকানন্দের জন্মোৎসব গেছে| তাই উৎসবের আমেজ| ফুলগুলো দেখে মন খুশী হয়ে ওঠে| বেশ সুন্দর রক্ষণাবেক্ষণ| শান্ত পরিবেশ| ছন্দে বাঁধা কাজকর্ম| ভিড় আছে কিন্তু শোরগোল নেই| মা সারদার মায়ের রান্নাঘর‚ ভাঁড়ারঘর‚ ঠাকুরঘর সব সুন্দরভাবে মাটির প্রলেপ দিয়ে করা| আমরা ভেবেছিলাম সিমেন্টের স্ট্রাকচারে মাটির প্রলেপমত দিয়ে করা| জনৈক ভক্ত বলেন না মাটি আর বালি দিয়ে করা| যাইহোক সবই বেশ ভালো লাগে| এখান থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ে পাই হিঞ্চেশাকের বেগুনি| গরম গরম ওসব দেখে না খেলেও ঠাকুর পাপ দেবেন (কোন ঠাকুর তা জানি না)| কয়েকটা কিনে ভাগ করে খেয়ে আমরা বাসে উঠি| কামারপুকুরে নেমে আমরা রামকৃষ্ণদেবের জন্মস্থান দেখতে যাই| এখানেও ফুলের মেলা| খুবই শান্ত পরিবেশ| সন্ন্যাসীদের আনাগোনা| এখানেও একইরকমভাবে মাটিরবাড়ি‚ ঠাকুরের গৃহদেবতা‚ ঠকুরের বড়ভাইয়ের ঘর সবই দেখি| ঠিক ৫ টা ২১ শে ঘন্টা পড়ে| আরতি হবে| ছেলেরা-মেয়েরা আলাদা বসার জায়গা| আমরা এসেছি যখন তখন আরতি দেখেই যাব| বসে যাই| বেশ সুন্দরভাবে আরতি দেখি| সবই খুব সঙ্ঘবদ্ধ| আরতি করা হয় রাককৃষ্ণদেবকে‚ তার গৃহদেবতাকে আর রামকৃষ্ণদেবের হাতে লাগানো একটি আমগাছকেও| একসাথে আরতি শুরু হয়‚ একসাথেই শেষ হয়| আমরা বেরিয়ে পড়ি| ওখানে সাদা বোঁদে বিখ্যাত| তাই কেনা হয়| চা খেয়ে আমরা বাসে উঠি| আর কোথাও থামা নয়‚ এবার সোজা ফিরে চলা নিজনিকেতনে| রাত নটায় আমরা ব্রিজে নামি| সবার বেশ মনখারাপ হয়ে যায়| আবার বাড়ি ফিরলাম এই ভালোলাগাটাও মনের মধ্যে লুটোপুটি খায়| শেষ
জল
আলোয় ফেরা ... টিভির সুইচটা অফ করে দেন নিভা| খবর দেখতে আজকাল বড্ড ক্লান্তি লাগে| মৃত্যুর হার রোজ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে| লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের হারও| সুস্থতার হারও বেড়েছে এইটাই যা স্বস্তির| কি যে এক রোগ এল‚ জীবনটাই আমূল বদলে দিয়েছে| বছর ঘুরে গেল তবু আতঙ্ক কাটল না| গত বছরে ঠিক এই সময় জীবনটা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল| শুরু হয়েছিল লক ডাউন| লক ডাউন শুরু হতেই নীতা একটা গাড়ি ভাড়া করে মেয়েদের নিয়ে চলে গেল তার স্বামীর কাছে| নিছক্ক একা তখন নিভা| এই বাড়িটা কেমন যেন গিলে খেতে আসত| চারিদিকে অপার শূন্যতা| চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে যাওয়া জীবন অবসাদগ্রস্থ| একটা কথা বলার লোক নেই| বইও যে বেশিক্ষণ পড়তে ভালো লাগে না| সারাদিন টিভি খুলে আর কত থাকা যায়| সেই এক খবরের চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা| রোজকার দিনে চলমান একমাত্র খবরের চ্যানেলগুলো| সিরিয়ালও বন্ধ| পুরোনো সিরিয়াল দেখতে ইচ্ছে করত না| শুয়ে বসে সময় কাটে না| পাড়ার লোকের সাথেই বা কথা হত কই| সবাই যেন সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখছে| প্রতিটা দিন‚ মুহুর্ত যেন কাটতেই চাইত না| ভরসা ছিল শুধু ঐ ফোনটা| একে তাকে ফোন করে কথা বলে কিছুটা যেন হালকা লাগত নিজেকে| কাছে-দূরে সবাই খোঁজ নিত শুধু নীতা নয়| অভিমান হত নীতার ওপর‚ নাতনীগুলোর ওপর| একটা বারও ফোন করে জানতে চাইত না‚ ' মা আপনি কেমন আছেন?''‚ 'ঠাম্মি তুমি কেমন আছ?'| সেইসব দুপুরগুলো‚ সেইসব রাতগুলো আজও মনে পড়লে মন যেন বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে| তারপর জীবন ছন্দ ফিরে পেলে নীতা ফিরে এল মেয়েদের নিয়ে| একবার মনে হয়েছিল ওদের আর বাড়িতে ঢুকতে বলবে না‚ বলবে‚ 'এখানে আর তোমাদের জায়গা হবে না‚ নিজের রাস্তা নিজে দেখে নাও|' কিন্তু ভাবনা ভাবা এক‚ বাস্তবে সেটাকে কাজে লাগানো আর এক| আর মায়া সেটা যাবে কোথায়? নিয়ন নেই‚ নিয়নের প্রতিভু মেয়ে দুটোর মুখে নিয়নের মুখ কেটে বসানো‚ তাদের দেখলে যেন নিয়নকেই দেখা হয়‚ তাদের ছেড়ে থাকতে যে বড় কষ্ট হয় নিভার| মেয়ে দুটোর মুখ চেয়ে আর কিছুই বলা হয়নি| তবে মনের মধ্যে কালবোশেখির ঝড় মাঝে মাঝেই টের পান| কিন্তু নীতাকেও কি কম ভালোবাসেন তিনি| আর এদের ছাড়া যে তিনিও খুব অসহায় সেকি আর বলে দিতে হয়| এইসব ভাবতে ভাবতেই ভাগবত গীতাখানা টেনে নেন| বই পড়তে বড় ভালোবাসেন নিভা| অবসর সময়ের এমন বন্ধু আর হয় না| যদিও চোখ এখন আর সাথ দেয় না তেমন করে‚ তবু নেশাটা আছে| এক আলমারী ঠাসা বই তাঁর| রামায়ন‚ মহাভারত‚ গীতা থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র ‚ রবীন্দ্রনাথ‚ শরৎচন্দ্র‚ তারাশঙ্কর এমনকি হাল আমলের সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যও তার সংগ্রহে| একটা সময় নিয়ম করে যেতেন বইমেলা‚ বই যে কিনতেন সববছর তা নয়‚ কিন্তু বইমেলা যাওয়াটা ছিল নেশার মত| ময়দানের ধুলো‚ বইয়ের স্টল‚ নতুন বইয়ের গন্ধ‚ মঞ্চে আলোচনা এইসব এখন খুব মিস করেন| খেয়েদেয়ে গরমের দুপুরে মেঝেতে একটা সুজনি পেতে আধশোয়া হয়ে বই পড়াটা তার অনেকদিনের অভ্যাস| মাঝে সাঝে ফোন আসলে বা নাতি-নাতনী কেউ একটা এসে না পড়লে এই অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটে| আজ যেমন নাতনী ইমলি এসে হাজির| অ্তএব বইটা সরিয়ে উঠে বসলেন নিভা| কিছু জানতে চাওয়ার আগেই ইমলি বলতে শুরু করল| 'ঠাম্মি‚ ঠাম্মি জানো আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল'| 'কেন রে দিদিভাই? মা কিছু বলেছে নাকি?' আদরের ইমলি এখন টিনএজার| এই বয়সের মনখারাপটা শরতের মেঘবৃষ্টির মত| এই ঝলমলে রোদ্দুর তো এই দেখ বৃষ্টি‚ খুব সাবধানে হ্যান্ডেল করতে না পারলে মুশকিল| 'না‚ না‚ ওসব কিছু না| জানো আমার ফেবারিট নায়ক সুইসাইড করেছে|' 'সেকি‚ কেন রে?' 'বলছে তো ডিপ্রেশন|' 'ডিপ্রেশন!!!" ইমলি চলে যায়| কিন্তু নিভার আর বইতে মন বসে না| আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই ডিপ্রেশন এত বেশি কেন বুঝে উঠতে পারেন না| অ্থচ জীবনে সুখ‚ দুঃখ আনন্দ বেদনার মত অবসাদও তো খুবই সাধারন হওয়া উচিত| না‚ এই নিয়ে কথা বলার অধিকার তার নেই‚ তিনি তো ডাক্তার নন‚ এ বিষয়ে পড়াশোনাও নেই| কিন্তু দীর্ঘ ৭৫ টা বসন্ত তিনি কাটিয়ে‚ জীবনের পড়ন্তবেলায় এসে আজও মনে হয় না একটা অবসাদ‚ একটা মনখারাপ‚ একটা অপ্রাপ্তির জন্য জীবনের মত এত সুন্দর কিছুকে শেষ করে দেওয়া যায়| তিনি নিজে তো কম আঘাত পান নি| আচ্ছা এরা কেন ভাবে না‚ এদের মৃত্যু তাদের প্রিয়জনেদের কতটা কষ্ট দেয়| একটু একটু করে দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে| নিভা তবু ওঠে না| ইমলির ফেভারিট নায়ক কে জানেন না নিভা‚ আজকালকার সিনেমার প্রতি কোন টানই অনুভব করেন না| কিন্তু সুইসাইড‚ ডিপ্রেশন শব্দগুলো নাগাড়ে মনে ঘোরাফেরা করতে থাকে| নিয়ন যখন চলে গেল তখন কতবার ভেবেছেন কি জন্য আর রাখবেন জীবন‚ কেনই বা রাখবেন? পুত্রশোকের মত কোন শোক হয় না| দীর্ঘ রোগভোগের পর নিয়নের মৃত্যু কি তিনিও কামনা করেননি? শেষের দিকে নিয়নের কষ্ট আর সহ্য করতে পারতেন না| অমর অবশ্য তার মাসখানেক আগেই গত হয়েছিল| পুত্রশোক তাকে পেতে হয়নি‚ পিতা হিসাবে সেদিক থেকে সৌভাগ্যবান| অমরও খুব ভুগছিল‚ অমরের মৃত্যু নিয়ে হাহাকার করার অবকাশই মেলেনি| নিয়নকে নিয়েই দিনরাত এক করে ফেলেছিল নিভা‚ নীতা| নীতা ছিল নিয়নের বউ সেই সময়| ইমলি তখন বেশ ছোট| তারপরই নিয়নের চলে যাওয়া‚ তার বছরখানেক বাদেই নীতার দ্বিতীয় বিয়ে| সে এক অবর্ণনাতীত একাকীত্ব| সেই সময় কতবার‚ কতবার ভেবেছেন‚ কাজ তো সব ফুরোলো আর কেন? আর কি বা দেখার আছে? কি বা শোনার আছে? ঈশ্বর যদি করুণা নাই করেন তবে নিজের হাতেই না হয় জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে নেওয়া যেতেই পারে| কিন্তু পারেননি| সামলে উঠেছেন‚ মেনে নিয়েছেন পুত্রশোক‚ মেনে নিয়েছেন পুত্রবধুর সিদ্ধান্ত| না ভুল | পুত্রবধুর সিদ্ধান্তটা পুরোপুরি মেনে নিতে পারেননি| পারাটা যে সহজ নয়| নিয়নের চলে যাবার পর দুটো মেয়ে নিয়ে নীতা একা হয়ে পড়েছিল| নিভা নিজেও কি কম একা হয়ে যায়নি| স্বামী-সন্তান দুই চলে গেল মাত্র ক মাসের ব্যবধানে| নিভার আজকাল খুব মনে হয় নিয়ন থাকতেই নীতা মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিল পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য| বাকিটা ছিল শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা| নীতা জানত নিয়ন বাঁচবে না‚ তবু এত তাড়াতাড়ি কি সম্ভব হয় পিছনের সম্পর্ককে ভুলে যাওয়া!! কে জানে হয়ত আজকের দিনে অনেক কিছু সম্ভব| তবু নীতা যদি বাইরের কাউকে বিয়ে করত নিভা এতটা আঘাত পেত না| নীতা বিয়ে করল নিজেরই মাসতুতো দেওরকে| যাকে নিভা এই দু হাতে মানুষ করেছে| নিজের সন্তানের সাথে কোনদিন তফাৎ করেও দেখেনি| আঘাতটা খুব সহজ ছিল না| তবু তখন লোক লজ্জায়‚ নিন্দায় একবারও মনে হয়নি নিজেকে শেষ করে দেওয়া এর থেকে অনেক সহজ| আর ডিপ্রেশন সে কথা কাকে বোঝাবে নিভা! সেইসব তো কাটিয়ে উঠে নিভা আজও সূর্যোদয় দেখে আর প্রতিদিন সেই অদৃশ্য শক্তিকে ধন্যবাদ জানান এই পৃথিবীর রূপ-রস আস্বাদন করার সুযোগ দেবার জন্য| জীবন মানেই টক-ঝাল-মিষ্টি-তেতো-নোনতা সবরকম স্বাদের মিশ্রণ| একটা থাকলে যে অপরগুলো-ও থাকবে| তবেই না জীবন পরিপুর্ণ হয়ে উঠবে| জীবন হচ্ছে পুর্নিমা-অমাবস্যার মত‚ জোয়ার-ভাটার মত| 'ঠাম্মি|' 'বল দিদিভাই'‚ ইমলির ডাকে মনের ভাবনা গুলোকে সরিয়ে নিভা সাড়া দেয়| 'তোমার কোলে একটু শুই'| 'শো-ও' নিভার পেতে রাখা কোলের ওপর বিছিয়ে পড়ে ইমলি| পরম মমতায় মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে নিভা জানতে চায়‚ 'এখনো মনখারাপ দিদিভাই?' 'কেন ঠাম্মি?' 'না‚ ঐ যে তখন বলেছিলে তোমার প্রিয় নায়ক মারা গেছে‚ তোমার সেই জন্য মনখারাপ|' 'হুম খারাপ তো লাগছে কিন্তু মন এখন অ্ত আর খারাপ লাগছে না ঠাম্মি| আর এই ডিপ্রেশন কি সেটাই তো আমি বুঝি না ঠাম্মি| আমারও তো ডিপ্রেশন হয়‚ কিন্তু আমার তো কখনও মনে হয় না তার জন্য জীবনটাকেই শেষ করে দেওয়া যায়|' স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিভা| 'দিদিভাই জীবন হল রোদ আর ছায়ার মত ‚ প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি মিলেই তো জীবন| তাকে সেই দৃষ্টিকোন থেকে দেখার দৃষ্টি তুমি পেয়ে গেছ দেখে আমার ভালো লাগছে| সুখেরও দুঃখ থাকে‚ হাসিরও কান্না থাকে| বুঝলে?' ইমলি মিস্টি করে হাসে| ক্ষণিকের জন্য যেন নিয়নকেই দেখতে পায় নিভা| ৭৫ বছরের শরীরটা যখন একটু একটু করে জবাব দিতে শুরু করেছে তখনও নিভার বসন্ত ভালো লাগে| বেঁচে থাকার দুঃখটা নয় সুখটাকেই নিভা আরও চেটেপুটে নিতে চায়| পড়ন্ত সুর্যের আলোকে বড় মায়াবী মনে হয়|
মনোজ ভট্টাচার্য
মাঝে মাঝে আমি ভাবতে আরম্ভ করেছিলাম – আমরা বোধোয় ভুল বুঝে কোন মানসিক হাসপাতালে এসে পড়েছি ! পুরো উন্মাদাগার নয় ! - এ ছাড়াও এই ভাবনার কারনও কিছু ছিল বৈকি । এক তো ঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যে থাকা ! আর ছিল প্রতিদিনের একই ধরনের অ-কাজাভ্যাস ! – আমি তো মাঝে মাঝে গেটের বাইরে ইচ্ছে করে বেড়িয়ে পড়তাম । ব্যাঙ্ক ইত্যাদির জন্যে কোন্নগর স্টেশনের দিকে যেতে হতো ! জানিয়ে যেতে হতো ! - তবে দারোয়ান ছাড়া কেউ কিছুই বলত না ! - কিন্তু আমি ঠিকই জানতাম কেউ না কেউ লক্ষ্য রাখছেই ! অন্ততই বাইরের লোকজন একটু ট্যারচা চোখে তাকাতই – আমার মনে হত ! আর সন্ধে বেলায় কুকুর তো চেঁচাতই ! এই আবাসের বেশ কিছু সদস্য ছিল ! তাদের আচরন সব যে স্বাভাবিক তা নয় !কেউ কারুর সঙ্গে ঝগড়া কলহ করে না বটে ! কিন্তু খেয়াল করলেই বোঝা যায় ! এক ভদ্রলোক – নাম জয়সয়াল ! সারাক্ষণ বিড় বিড় করেই যাচ্ছে ! শুনেছি বড় বাজারে ওর নাকি দোকান ছিল । ভাইপোরা ওকে হাটিয়ে দিয়ে এবং এখানে ভর্তি করে দিয়ে গেছে ! মাসে মাসে নিশ্চয় টাকাও দিয়ে যায় ! – উনি মাটিতে কোন কাগজ দেখলেই তুলে নেয় ও পকেটে রেখে দেয় ! – অথচ এসে ওনাকে অন্যদের সঙ্গে দাবা খেলতেও দেখেছি ! এক জনের কথা কি লিখেছি ? রাত্তিরে কিভাবে হোম থেকে হাওয়া হয়ে গেছিলো ! পরের দিন খাওয়ার সময়ে হাজির ! রাত্তিরে কোথায় ছিলেন ? শ্যামবাজারে গুরুর ঠেকে গেছিলেন উনি ! কারন গুরু ওকে স্বপ্নে আদেশ করেছিল – ওর দাদার শ্বশুরমশায়ের শরীর খুব খারাপ ! পকেটে ছিল না ফুটো কড়ি ! আরেক জন আছেন দাদাজী – দারুন স্বাভাবিক ! সকালে প্রত্যেককে গুড মর্নিং করেন । দু-তিনটে কাগজ পড়েন – খেলার পাতা । সে তো আমরাও পড়ি । কিন্তু তারপর পকেট থেকে ছোট্ট ডায়রি খুলে রেকর্ড লিখতে আরম্ভ করে ! তাইতেই অনেকটা সময় যায় ! – সব শেষে খুটুর খুটুর করে পাশের একটা মন্দিরে গুড মর্নিং করে আসেন ! এক বয়স্কা মহিলা – তার আয়া আছে – তবু কি করে গেটের কাছে চলে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করতো বাড়ি যাবার জন্যে ! আয়া ধরে আনত ! - একদিন অতনুশ্যর আর আমাকে প্রায় হাতে পায়ে ধরে কী ভীষণ কান্নাকাটি ! বাড়ির ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা একটা কাগজ দেখিয়ে বলেন একবার তার ভাইপোকে দেখে আসবেন । ভাইপোর নাকি জ্বর ! – যত খারাপই লাগুক না কেন – আমরা তো পারিনা ! – পরে জানা গেল – উনি যখন এসেছিলেন – তখন নাকি সে অসুস্থ্য ছিল ! আপন গৃহে ফিরে আয়না দেখে কিছু বুঝতে পারিনি – মস্তিষ্কের কোন পরিবর্তনের কথা ! – তবে বেশ কিছুদিন বাদে একটা লিফটের গল্প লিখতেই বোধয় – ধরা পড়লো !
জল
ভোর ভোর উঠে আমরা তৈরি হয়ে নিয়েছি| কিন্তু মালপত্র নামাবে কে? স্টাফেরা সবাই তো ব্যস্ত| হোটেল বয়গুলো ঘুমুচ্ছে| এত লাগেজ নামানো আমাদের কর্ম নয়| হোটেলে রিসেপশনে বলতে ওরা ওদের ছেলেদের ডেকে তুলে দেয়| মালপত্র নামিয়ে দেয় ওরা| আমাদের বাসে মালপত্র লোড হয়ে যায়| চারিদিকে ঘন কুয়াশা| রাত শেষ হয়েছে মনেই হয় না| সকালে বেড টি খেয়েছি‚ তবে এখনও মন চা চা করছে| চারিদিক ভিজে সপসপ করছে| প্রায় সাতটা সাত নাগাদ বাস ছেড়ে দেয়| সামনে শুধু কুয়াশার জাল| পোখরাতে অন্নপুর্ণা বেস ক্যাম্প| এখান থেকে অন্নপুর্ণা পর্বতশ্রেনীর দৃশ্য কোন বাঁধা ছাড়াই সামনাসামনি দেখা যায়| ওত কুয়াশার মধ্যেও অন্নপুর্ণা আমাদের সামনে যেন নিজেকে যেন তুলে ধরে| সুর্যের কিরণে যেন পিছলে যাচ্ছে শ্বেতশুভ্র পর্বতশ্রেনী| উচ্ছ্বাসে আমরা উদ্বেলিত হয়ে উঠি| জীবন যেন সার্থক ঐ তুষারশুভ্র চুড়া দেখে| ঘন কুয়াশা‚ ঠান্ডা‚ এত ভোর ভোর উঠে রওনা দেওয়া সব ক্লেশ‚ সব কষ্ট যেন দুর হয়ে যায়| বাস স্লো যায়‚ আমরা দেখতে থাকি‚ চেষ্টা করি ক্যামেরা বন্দী করার| হ্য় আবার হয়ও না| ধীরে ধীরে মুছে যায় চোখের সামনে থেকে হিমালয়| মন খারাপ হতে থাকে| আমরা এগিয়ে চলি| আজ আমাদের গন্তব্য রক্সল| সকাল থেকে আবহাওয়া যেন মুখ ফিরিয়েছে| আকাশ অংশত মেঘলা| সাথে জোরদার কুয়াশা| সঙ্গী ধুলো| সকাল থেকেই রাস্তার কাজ শুরু হয়ে গেছে| স্থানে স্থানে বাস জ্যামে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে| আসার দিন দিনের আলো ছিল না তাই রাস্তা দেখতে পাইনি‚ কিন্তু ফেরার সময় দেখতে পাচ্ছি রাস্তা এবড়ো খেবড়ো‚ কোথাও সরু‚ কোথাও বাঁক সাংঘাতিক| ধুলোয় গাছের পাতা মলিন| গতরাতে সেভাবে তো ঘুম হয়নি| বারবার উঠেছি| পাছে ঠিকসময় না উঠতে পারি সেই ভয়ে| চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না| সৃজনী ঘুমিয়ে পড়েছে| মনীষাও ঘুমোচ্ছে| তনিশার শরীরটা বেশ খারাপ| পোখরা আসার দিন থেকে যে তার শরীরটা খারাপ হয়েছিল‚ তার সেই জের এখনো চলছে| আজও তো পাহাড় থেকে পাহাড় হয়েই আমরা সমতলে নামব‚ প্রায় ২৬০ কিমি রাস্তা| ওরা তিন মা-মেয়ে আগেই ওষুধ খেয়ে নিয়েছে পাছে বাসে বমি হয়| অনেকটা রাস্তা যাবার পর একটা পেট্রোলপাম্প মত জায়গায় আমাদের বাস থেমে গেল| ড্রাইভার জানালো কেউ যদি টয়লেটে যেতে চান ঘুরে আসুন‚ এরপর গাড়ি সেই মঙলী ব্রিজ পেরিয়ে গিয়েই থামবে| অনেকেই যায়| আমাদের বাস থেকেও কেউ কেউ যায়| তনিশাও যায়| ড্রাইভার তাড়া লাগায়| তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে তনিশা জোরে পড়ে যায়| ভাগ্গিস দুটো ট্রাউজার পড়েছিল‚ তাই আঘাতটা পায়ে সেইভাবে লাগেনি| ওপরের ট্রাউজারটা ছিঁড়ে যায়| একেই রোগা মেয়েটা‚ তার ওপর কদিন ধরে শরীরটা খারাপ আরও নেতিয়ে পড়ে| ওদিকে গুল্লুও কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে| বাসের প্রায় সবাই আমরা ঢুলছি| কখনও জাগছি‚ কখনও ঝিমুনি খাচ্ছি| এইভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল| আসার সময় যে উৎসাহ থাকে‚ ফেরার সময় তাতে ভাঁটা পড়ে যায়| এক্ষেত্রেও তাই| আমি আসার দিনের বাসের যেদিকে বসেছিলাম সেদিক দিয়ে ত্রিশুলী নদী দেখা যাচ্ছিল কিন্তু ফেরার দিনে বাঁদিক জুড়ে শুধুই পাহাড়| আর এদিকের পাহাড়গুলো যেন বড় রুক্ষ্ম| এই পাহাড়গুলোকে কেটেই চলেছে রাস্তা বড় করার কাজ| কোথাও কোথাও পাহাড় ছাড়িয়ে লোকালয় চোখে পড়ছে| এখানে এইসময় পরীক্ষা চলছে মনে হয়| স্কুল থেকে ফেরতা ছেলে মেয়েদের হাতে এক্সাম বোর্ড আর তাতে লাগানো কোয়েশ্চেন পেপার| হয়ত বা আজ পরীক্ষা শেষ কারও কারও তারা পার্শ্বস্থ মাঠে ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করা ছেলেদের সাথে একটু খেলে নিচ্ছে| কোনও বাড়ির বাইরের দাওয়ায় বসেছে চায়ের আসর| ছেঁড়া ছেঁড়া রোদে পিঠ দিয়ে সাংসারিক গল্প করতে করতে চলছে চা পানের আসর| কেউ বা পিঠে করে বয়ে নিয়ে চলেছে কাঠকুঠো| টুকরো টুকরো দৃশ্যের কোলাজ| সবকিছুকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি আমরা কাঠমান্ডুর পথে| বাঁদিকে সেই একঘেয়ে ধুসর বিবর্ণ মনখারাপ করা পাহাড়| কতক্ষণ পথ চলছি আমরা! প্রায় ১১টা বাজতে চলেছে| ব্রিজের ওপর সার সার বাস| আমাদের বাস প্রচন্ড গতি বাড়িয়ে ব্রিজের ওপর উঠে গেল| বেলা ১১টা বাজার আগে যেসব বাস বা গাড়ি এই ব্রিজে উঠে যাবে সেগুলোকে এরা ছেড়ে দেবে| ওদিকে পরপর টায়ার দিয়ে পিছনের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে| সামনে লম্বা বাসের সারি আপ- ডাউনের| অল্প অল্প করে ছাড়ছে| একবার ওদিক থেকে এদিকে আসছে আর একবার এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে| ধীরে ধীরে আমরা মঙলী ব্রিজ পেরিয়ে যাই| সকাল সাড়ে নটা-দশটা নাগাদ আমরা আমাদের ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছিলাম| আজ ছিল বান‚ কলা আর ডিমসেদ্ধ| এখন সবারই চা তেষ্টা পেয়েছে| ড্রাইভারকে বলা হয় এমন কোন ধাবাতে দাঁড়াতে যেখানে লেডিস টয়লেট আছে| বাস এরপর দুটো জায়গায় দাঁড়ায় কিন্তু কোথাও কোন লেডিস টয়লেট ও নেই আর সেখানে চা'ও মেলে না| অ্তএব আমরা আবারও বাসে চলতে থাকি| ড্রাইভারেরও ক্ষিদে পেয়েছে‚ "কিন্তু ঢ্ং কা রেস্টুরেন্ট মিল নহি রহা হ্যায়|" ড্রাইভার একটা জায়গায় এনে দাঁড় করায়| সেখানে বেশ কিছু মোটর মেকানিকের দোকান| দু একটা ধাবা| টয়লেট নেই| কি আর করা| আমরা ওখানেই দোকানে চায়ের অর্ডার দি| সবকটা বাস একসাথে এসে পড়ায় দোকানী হাল পায় না| আমাদের চাপান শেষ হয়ে গাড়িতে উঠব‚ ড্রাইভার সাহেবরা ঘোষনা করলেন ওঁনারা এখানেই লাঞ্চ করবে| অ্তএব ওরা দোকানে বসে গেলে খেতে| আমরা মিলে মিশে টুকটাক কিছু কিনলাম| এখানকার একটা চিপস প্রাণ পোটাটো ক্রাকারের মত দেখতে হলেও খেতে বেশ অন্যরকম আর খুব ভালো| ড্রাইভার আসতে আসতে আমরা দোকানের একটা টিঁয়াপাখিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম| সে আমাদের মাথায় -ঘাড়ে উঠল| ভয় পাচ্ছিলাম কিন্তু ভালো-ও লাগছিল| বাস ছেড়ে দিল| আবারও সেই পথচলা| এক শহর থেকে অন্য শহর‚ এক নগর থেকে অন্য নগর ক্রমাগত আমরা ছাড়িয়ে চলেছি| একজায়গায় দেখলাম বেশ বিয়েবাড়ি হচ্ছে| আমরা সমতলে আছি বেশ বুঝতে পারছি| এখানে লোকালয় প্রায় চোখে পড়ছে| চোখে পড়ছে সবুজ ক্ষেতখামার‚ ফুলের বাগিচা| চোখে পড়ল একজায়গায় একটা টোটো| বেশ উচ্ছ্বল হয়ে উঠলাম| যেন মনে হল কতদিন পর পরিচিত জগতের দেখা পাচ্ছি| ধীরে ধীরে যত এগোচ্ছি তত যেন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে‚ বৃদ্ধি পাছে গাড়ির সংখ্যাও| মানুষ-জন-দোকান-পাট বেড়েই চলেছে| প্রায় দুপুর দুটো নাগাদ আমাদের বাসে তোলা হল জলের বোতল একটা দোকান থেকে| এত জনবহুল এলাকা তবু কোথাও কোন পাবলিক টয়লেট নেই| আমাদের অবস্থা খুব খারাপ| এক জায়াগায় একটা পার্ক মত জায়গা| অনেকটা বড় জায়গা| চারিদিকে বড় বড় গাছপালা‚ জঙ্গল| মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে| এলাকা তেমন একটা জনবহুল নয়‚ বরং বেশ ফাঁকাই| সেখানেই আমাদের লাঞ্চ দেওয়া হল| ভাত আর ফুলকপির তরকারি| কিন্তু খাওয়া মাথায় থাক‚ আগে একটা টয়লেট দরকার| একে ‚ তাকে জিগিয়েও কোন টয়লেটের হদিশ মিলল না| দু-একটা ধাবার লোকেরা বলল‚' জঙ্গল মে মঙ্গল কিজিয়ে '| আমাদের চক্ষু চড়কগাছ| শেষে কিনা জঙ্গলে!!! না না করেও শেষে আমাদের আর ধৈর্য ধরল না| এখনো ঘন্টা তিনেকের জার্ণি| আমার বেশ মনে আছে‚ সেই ছোটবেলায় পিসিমণির সাথে দক্ষিণেশ্বরে গেছিলাম| তখন তো এত উন্নত ছিল না রাস্তাঘাট‚ ছিল না পাবলিক টয়লেট এখনকার মত এত| ঠিক এইরকম অবস্থা| ছোট ছিলাম বলে অসুবিধা হয়নি| কিন্তু কাই-মায়ের অবস্থা আজ বুঝতে পারছিলাম| পিসিমণি লাস্টে একটা ট্রাকের পিছনেই মঙ্গল করতে বসে পড়ল আর ঠিক সেই মুহুর্তেই ট্রাকটি বেরিয়ে গেল| কি যে অপ্রস্তুত অবস্থা আমার এখনও মনে আছে| কিন্তু কিছু করার নেই| আমরা জঙ্গলেই যাই| রূপাদি বিজ্ঞের মত বোঝালেন‚' সবধরনের অভিজ্ঞতাই করে রাখবি'| অ্তএব চলো জঙ্গলে যাই| আবার বাস ছেড়ে দেয়| সমতল বেয়ে আমরা চলেছি অনেক রাস্তা| মাঝে মাঝে ঘনবসতি আবার কোথাও কোথাও ফাঁকা| একরের পর একর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে| বিকেলের মরা আলোয় ভাঁটার টান| একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ায় বাস| প্রচন্ড ঠান্ডায় চা না হলেই চলছে না | একটা দোকানে আমরা চা খাই‚ সাথে বিস্কুট| পকৌড়াও ছিল কিন্তু এইমাত্র শেষ হয়ে গেল| গোবির একটা সব্জি হচ্ছিল কসুরি মেথি দিয়ে‚ গন্ধটা দারুন| এই ধাবাটা একটা বাড়িতেই| তাই বাড়ির তলাতেই মিলল টয়লেট| অনেকেই গেল| বাড়ির মালকিনের সব মেয়ে| সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে| সবাই বর-বাচ্চা নিয়ে এখানেই থাকে| নেপালী মেয়েরা বড় সুন্দরী হয়| ভরন্ত সংসার| ঠান্ডার চোটে দুকাপ চা খেয়ে নি| বেশ কিছুটা সময় এখানে চলে যায়| বাসে উঠতে উঠতেই দিনের আলো নিভে যায়| বীরগঞ্জ খানিক আগেই ক্রশ করেছি আমরা| এবার বাস রক্সালের পথে| আর মিনিট কুড়ির মধ্যে আমরা ঢুকে যাব বিহার সীমান্ত| তার আগেই বর্ডারে চেক হল তিনবার| একবার নেপাল বর্ডারে‚ একবার ইন্ডিয়া বর্ডারে আর একবার লোকাল পুলিশ পেপার চেক করে ঢুকতে দিল| রক্সলে স্টেশনের কাছেই আর এস হোটেলে আমাদের রাত্রিবাস| কাল সকাল দশটার ট্রেনে আবার ফেরা সেই থোড়বড়িখাড়া জীবনে| কিছুটা অক্সিজেন ভরে নিয়ে আবার সেই জীবনে জূতে যাওয়া| কু ঝিক ঝিক করে আবার সেই চলা‚ সেই ঘুম ভাঙতে না চাইলেও ওঠা‚ সেই রোজকার একঘেয়ে কাজ‚ সেই অফিস‚ সেই বাড়ি‚ সেই লোকাল ট্রেনের ভিড়‚ সেই পড়তে বস না জীবনে আবারো ফিরে আসা| মাঝের সময়টা যেন কেটে গেল স্বপ্নের মত| আবার স্বপ্ন বুনতে কোথাও উড়ে যেতে যখন মন চাইবে‚ পকেটের রেস্ত পারমিট করবে‚ সঙ্গী-সাথী মিলবে আবার কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান প্রোগ্রাম তৈরী হবে তখন আবার ফিরে আসব চেনা পথের চেনা-অচেনা গল্প নিয়ে| এতদিন ধরে যারা আমার বকবকানি থুড়ি এই খাজা লেখাটি পড়লেন‚ সঙ্গে রইলেন‚ উৎসাহ দিলেন কিম্বা নীরব পাঠক পাঠিকা হয়েও আমার লেখাটি পড়লেন তাদের প্রত্যেককে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ|
জল
দেখতে দেখতে দুটোদিন দ্রুত কেটে গেল| আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখভার| চারিদিকে কুয়াশার পাতলা চাদর বিছিয়ে আছে| সেই সঙ্গে প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া| আমাদের রুমের ঠিক নীচেই আজ সকাল থেকেই চলেছে আগুন পোহানো| ফুটন্ত গরম জল যেন মুহুর্তে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে| এদের এখানে সোলার প্যানেল প্রতিটা ছাদে বসানো| এই হোটেলের ছাদের দুদিকে গোটা আষ্টেক করে মোট ষোলোটি প্যানেল দেখলাম| সারা ছাদে পায়রার বিষ্টা ভর্তি| ছাদ থেকে একটু দূরে দেখা যাচ্ছে প্রচুর মোটর গাড়ি| ওটা সম্ভবত কোন গ্যারেজ| আমাদের হোটেলের বাউন্ডারি দিয়ালের পাশেই JCT প্রচুর ক্রেন‚ আনুমানিক গোটা পঞ্চাশেক তো হবেই| মুল সদর রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি চললেও সংখ্যায় নগন্য বলা চলে| নিচে চলছে জলখাবার পর্ব| আমরাও বসে পড়ি| ভোরবেলা অবশ্য আমাদের বেড টি আর বিস্কিট সার্ভ করা হয়েছিল| গরম গরম লুচি আর আলুর তরকারি| গোটা চারেক সাবাড় করে দি| এমনিতেই এতদিনের বুভুক্ষু আমি| কদ্দিন লুচি‚ ভালো খাবার দাবার খাই না| এখানে তো আর সেদ্ধ-সাদ্ধা আমার জন্য কেউ করবে না আর করলেও খাচ্ছি না| দেশের প্রান্তরেখা পার করার পর থেকেই আমার শরীর বেশ চনমনে| অনেকটা এই কারণেই বের হওয়া| একটা চেঞ্জ সত্যিই দরকার ছিল| আরও দুটো লুচি অনায়াসেই খেয়ে ফেলে ভাবছি বাপরে আমার কি খাওয়া বেড়ে গেল| পেটটা না বাড়লেই হয়| অনেক কষ্ট পেয়েছি| বেলা ১১ টায় বের হব আমরা লুম্বিনীর উদ্দেশ্যে| সনাউলি থেকে লুম্বিনীর দুরত্ব প্রায় ৩১ কিমি| নিজেরা তৈরি হয়ে নিয়ে নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসি| লুম্বিনী‚ একটি ঐতিহাসিক স্থান| বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে অবশ্য দর্শনীয় একটি তীর্থক্ষেত্র| ৫৬৪ মতান্তরে ৫৬৬ খ্রীষ্ট্রজন্মপুর্বে লুম্বিনীতে জন্মগ্রহন করেছিলেন তথাগত বুদ্ধ| রূপানদেহি রাজ্যের একটি প্রদেশ হল লুম্বিনী| আমাদের ড্রাইভারজী সেই আগের দিনের মতই আমাদের প্রণাম জানিয়ে সম্বোধন করলেন| ওঁনার এই সম্বোধনটা খুব ভালো লাগে| রূপানদেহি বেশ জনবহুল| হোটেলের পাশাপাশি অনেক বাড়ি আছে| প্রতিটা বাড়িতেই ব্যালকনিগুলো খুব চওড়া| ব্যালকনিগুলো লোহার বা স্টিলের মোটামোটা বিম বা পাইপের মত বিম দিয়ে ঘেরা| আমাদের কলকাতার মত ব্যালকনিগুলো ক্ষুদ্র আর পুরো গ্রিল দিয়ে ঢাকা নয়| এখানে প্রতিটা বাড়ির ওপরেই একটা করে চুড়ো| প্রতিটা বাড়িতেই ফুলের সম্ভার চোখ টানে| আমাদের ড্রাইভার দেখালো সির্দ্ধার্থ নগরের ছোট বিমানপোত| কুয়াশার জন্য অস্পষ্ট| সামনে লুম্বিনী সাংস্কৃতিক পার্কের প্রথম তোড়নটি| আমরা বেশ কয়েকটি খোলা পার হই| প্রথমে ভেবেছিলাম এগুলি বুঝি খাল কিন্তু তাকিয়ে বুঝি খোলা মানে সরু পাহাড়ী নদীই হবে| নদীগুলো বর্ষাকালে জলে পুষ্ট হয়ে ওঠে| এখন তেমন জল নেই| প্রচুর নুড়ি আর পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে| এর মধ্যেই একটা বড় জলাশয় পার হই| পাথর কেটে কেটে সিঁড়ি করা| অনেক ডিঙি তীরে বাঁধা| সম্ভবত কোন ঝিল| এখানে দোকান-পাট সর্বত্রই হিন্দী স্ক্রিপ্ট| ইংলিশ প্রায় দেখাই যায় না| হিন্দীতে অ্ত দর নই‚ মোটামুটি পড়তে পারি এই পর্যন্ত| কোনটা কি নদী বা জলাশয় এখানে তেমনভাবে মার্ক করাও নেই‚ যা আছে তাও হিন্দীর জন্য পড়তে পারিনা| যদিও হিন্দী‚ উচ্চারণ অনেকাংশে কিন্তু হিন্দীর মত হচ্ছে না| লুম্বিনীর দ্বিতীয় তোড়নটিও পার করে যাই| রাস্তাঘাট এখানে ভীষন ফাঁকা| পাবলিক বাস বা গাড়ি তেমন একটা চোখে পড়ে না| কিছু হোটেল আর বিক্ষিপ্ত দোকানপাট নজরে আসছে| হঠাৎ করেই বাস থেমে গেল| একটা খালি ফাঁকা জায়গায় সার দিয়ে আমাদের তিনটে বাসই দাঁড়িয়ে গেল| এতক্ষণে গাড়ির ভিতরে ঠান্ডা তেমন টের পাইনি| নীচে নেমেই কাঁপুনি ধরে|এতগুলো পোশাক ফুঁড়েও ঠান্ডা যেন শরীরে বিঁধছে| আকাশ এখনও মেঘলা| কুয়াশায় পরিপুর্ণ চারিপাশ| উদ্যোক্তরা টোটো ভাড়া করে| প্রতি টোটো চারজন করে| অনেকগুলো টোটো পরপর রেডি হয়ে যায়| একসাথেই যাবে| লুম্বিনী পার্ক একটা মস্ত জায়গা জুড়ে অবস্থিত| কয়েকশো একর জমি জুড়েই কাজ চলছে| লাল পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে চলতে শুরু করল আমাদের টোটো| ঝাঁকুনি আর ঠান্ডার চোটে নাক মুখ সব যেন বরফ শীতল| নাক -কান-মুখ ঢেকেও যেন ঠান্ডা আটকাতে পারছি না| আমরা অবশেষে কাম্বডিয়ার মনেস্ট্রির সামনে এসে হাজির হলাম| ভিতরে ঢুকে চারিদিকের শান্ত পরিবেশ যেন আমাদের আকর্ষণ করছে| এখানে জোরে তো নয়ই ফিসফিস করে কথা বলতেও ইচ্ছে করবে না| এদিকে ওদিকে বিভিন্নরীতির মনেস্ট্রি| কোনটা ফ্রান্সের কোনটা কাম্বোডিয়ার‚ কোনটা জাপানের| মাঝের সরোবরে প্রস্ফুটিত জলপদ্ম| এখানে ফটো তোলা মানা| এক বিশাল কালো কিম্বা কালো মিশ্রিত খয়েরী বুদ্ধমুর্তির সামনে আমরা যেন কত ক্ষুদ্র| বুদ্ধের চোখদুটি যেন জীবিত| যেদিক দিয়েই তাকাই সেদিক দিয়েই যেন তথাগত আমাদের তার অর্ধনিমিলিত নয়নে দেখছেন| মনে মনে বলি বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি| ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে স্বয়ং বুদ্ধ আজ সামনে বিরাজমান| মুর্তিটি মনে হয় কাঠের| চারিদিকে বুদ্ধের বিভিন্ন প্রতিরূপ| কোনটিতে বুদ্ধ তপস্যারত‚ কোনটিতে তিনি তার শিষ্যদের বানী দিচ্ছেন| এখান থেকে বেড়িয়েই টোটো ড্রাইভার তার ফোনটি হাতে ধরায়| আমরা দলছুট হয়ে পড়েছি| আমাদের বাকি টোটোগুলো সব একসাথে আছে| তড়িঘড়ি আবার সেদিকে দৌড় লাগায় আমাদের টোটো| রাস্তা যেহেতু তৈরি হচ্ছে তাই ঝাঁকুনি খেতে খেতে আমরা এগোতে লাগলাম| পুরোটা একদিনে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়| অনেকগুলো বুদ্ধ মনেস্ট্রি আমরা ঘুরলাম আর ফটো তুললাম| এবার আমাদের গন্তব্য তথাগতর জন্মক্ষেত্র মায়দেবীর মন্দির| মায়াদেবীর মন্দিরের টিকিটের লাইনের বেশ ভিড়| আমরা সার্ক দেশভুক্ত বলে আমাদের টিকিট এন সি তে ৬০ টাকা| আমরা টিকিট কেটে জুতোঘরে জুতো রেখে রওনা হই| এখানে প্রচুর স্তুপ‚ প্রাচীন পুস্করিণী যেখানে সদ্যজাত সিদ্ধার্থকে স্নান করানো হয়েছিল ইত্যাদি আছে| চারিদিকে এখানেও প্রচুর কাজ চলছে| মায়াদেবীর মন্দিরটি বাঁধিয়ে রাখা হয়ছে| ভিতরে ঢুকলে সেই ঐতিহাসিক যুগে যেন পদার্পণ করলাম মনে হবে| ইতিহাস তার সাক্ষ্য রেখেছে এখানে| প্রায় ধ্বংসস্তুপকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে অ্ত্যন্ত দক্ষতার সাথে| ভিতরে প্রচুর পায়রা| ইতি উতি সিসি ক্যামেরা ও প্রখর পাহারা| প্রচুর নেপালি আর ভারতীয় টাকা ছড়িয়ে আছে| ইঁটগুলোকে কি চুনকাম করা হয়েছে? হয়ত কিম্বা এমনটাই ছিল| একদিকে সিদ্ধর্থের আঁতুড়ঘর| যে শিলাটির ওপর তথাগতের জন্ম হয়েছিল সেটি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে কাঁচ দিয়ে এবং সেখানেও সিসি টিভি ক্যামেরা| বৌদ্ধদের বিশাল ভিড়‚ ভক্তিও তেমন| বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দিচ্ছে না| বেরিয়ে এলাম| বেরিয়ে অশোকের পিলার| ওখানে বর্ণিত আছে চন্ডাশোক‚ ধর্মাশোকে পরিণত হয়ে এখানে এসেছিলেন| ১৮৯৬ সালে আবিষ্কৃত হয় এই পিলার| ১৯৯৭ সাল থেকে লুম্বিনী ওয়ার্লড হেরিটেজ প্লেস| আরও অনেককিছুর মধ্যে এখানে বেশিরভাগ স্তুপের ধ্বংসাবশেষ| পায়ে পায়ে ফিরে চলি আমাদের টোটো-ওয়ালেদের কাছে| বেরোনোর সময় একটা ব্রিজ পার করেই চলে আসি যেখানে আমাদের বাসগুলো দাঁড়িয়ে ছিল|
Aloka
টিভি খুব একটা না দেখলেও বাংলা প্রোগামের মধ্যে দিদি ন্ং ১ টা মোটামুটি নিয়মিত ই দেখে থাকি| তার একটা কারণ যদি হয় সঞ্চালনার গুণ আর একটা অব্শ্যই জীবন ও জীবিকার জন্য জন্য মেয়েরা যে কত কিছু করছে তা শোনার জন্য| কেউ এসেছে বিপাকে পড়ে কেউ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে পেশা শুনলে সত্যিই ভালো লাগে| যে এত কাল ধরে যে পেশা গুলো সাধারণ্ত মেল ডমিনিটেড ছিল সেখানে ও তারা পা ফেলছে| এই যেমন দু একদিন আগে এক্জন বলল সে ইলেক্ট্রিকাল কন্ট্রাক্টর ওয়ারিং এব্ং আরো নানা রকম কাজ কর্ম করে এব্ং লাইসেন্স হোল্ডার| আর তার কথা অনুযায়ী তার ক্ষেত্রে সে একা মহিলা| এখন গভর্ণমেণ্টেরো কাজ করে থাকে| বেশ কিছুদিন আগে এই রকমই এক্জন বলে ছিল সে স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের ইন্জিনিয়ার ‚ঠিক ডেসিগনেশন টা মনে নেই তবে হাই টেনশন লাইনের মেন্টেনান্স বা এই ধরনের যথেষ্ট ঝুঁকি পূর্ণ কাজ করে| দরকার হলে রাত বিরেতেও বেরোতে হয়| বিবাহিতা এব্ং একটি বাচ্চা আছে| পরিবারের পুরো সাপোর্ট পায়| আর এক্জনের কথা মনে পড়ছে সে রেলওয়ে তে কাজ করে| ক্লিপিংস দেখাচ্ছিল একটা উঁচু টাওয়ারের ওপর উঠে কি যেন করছিল |সিগনালিং বা মেনটেনান্স স্ংক্রান্ত কিছু মনে হচ্ছে| বলল এতদিন সে একা মহিলা ছিল এখন আর এক্জন জয়েন করেছে| কিছুদিন আগেয় একজন সিভিল কন্ট্রাক্টারের ও দেখা পেয়েছিলাম|মালপত্র কেনাকাটা থেকে তদারকি সে একা হাতে সব সামলায় বলেছিল| একটু ভুল বললাম ক্ষেত্র গুলো এখনো হয়্ত মেল ডমিনেটেড কিন্তু এতদিন মেয়েদের দ্বারা আন ভেঞ্চারড ছিল এখন সেখানে ঢুকছে| মেয়েদের জন্য এই সব ক্ষেত্র গুলো প্রহিবিটেড ছিল কিনা তা অব্শ্য আমি জানি না| (যেমন এতদিন নাকি নিষিদ্ধ ছিল মাত্র কিছুদিন আগে মেয়েদের ফাইটার প্লেন চালানোর অনুমতি মিলেছে| ) সীমিত জ্ঞানে আমার ধারণা শেয়ার বাজার আর একটা ক্ষেত্র যেখানে অবাঙালী ‚ ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়েরা বহুদিন আগেই প্রবেশ করেছে আর রীতিমত স্বচ্ছ্ন্দ কিন্তু এত দিন পর্যন্ত এটা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালী মেয়েদের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল না| ভুল টা ভাঙল কয়েকদিন আগে একট মেয়ের কথায়| খুবই অল্প বয়স মেয়েটির কিছু একটা কোর্স ও করছে যেন বলল সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার ট্রেডিং এ ও শিক্ষা নিচ্ছে| অব্শ্য ওর বাবা না জ্যাঠা কার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে| আমি তো শুধু এর কথাই শুনলাম জানি না এ রকম আরো মেয়েরা এই ক্ষেত্রে আছে কি না মাছের ব্যবসা| না শুধু কেনা বেচা না রীতিমত চাষ তাও একটা আধটা পুকুরে নয় পুরোদস্তুর ফিশারী যেখানে আধুনিক উপায়ে মাছ চাষ হয়|সেটাই করে হাওড়ার এক মেয়ে| ব্যবসাটা ছিল তার বাবার| তিনি অসুস্থ হওয়ায় সে হাল ধরেছে খানিকটা বিপাকে পড়েই | তবে এখন সে পুরো আয়্ত্ত্ব করে ফেলেছে মাছ চাষের অন্ধিসন্ধি| স গর্বে জানাল মেয়েটি কলেজে পড়ছে আবার দরকারমত ক্ষেতে নেমে চাষ ও করছে| ভিডিও ক্লিপিং সহ জানালো হুগলি জেলার চাষী পরিবারের একটি মেয়ে| শুধুতাই নয় এই কাজে তার কলেজের মাস্টারমশাই এর ও সমর্থন ও দরকার মত সাহায্য ও সে পেয়ে থাকে‚ কলেজের পড়া শেষ করে ক্ষেতের কাজ নিয়েই সে থাকতে চায় আর আধুনিক ও উন্নত প্রথায় কি করে চাষের উন্নতি করা যায় সে খোঁজ খবর ও সে করবে বলে জানিয়েছে অটো| ট্যাক্সি|বাস ট্রেন চালানো স্ংখ্যায় কম হলেও বহুদিন ধরেই করে আসছে মেয়েরা বাড়ি বাড়ি গ্যাস ডেলিভারি দেওয়া(( ভাবুন ঐ ভারী ভারী সিলিণ্ডার বয়ে নিয়ে যাওয়া) তার তুলনায় সহজ বাড়ি বাড়ি কগজ বিলি করা .. এমন মেয়েদের ও দেখা পেয়েছি এইমঞ্চে| সঞ্চালিকা রচনা ব্যানার্জীর কথাও একটু বলি| যে যে কাজই করুক না কেন তার কাজটাকে appreciate (য ফলা দিতে পারলাম না অ্তএব.|) করা আর তাকে উৎ্সাহিত করা এই কাজটা অ্ত্যন্ত সফল ভাবে সে করে থাকে | এই মঞ্চে আগত অনেকেই মুক্তকণ্ঠে সে কথা স্বীকার করে| অভিনেত্রী হিসেবে সে কেমন আমি জানি না‚ রামধনু ছাড়া তার আর কোন সিনেমা আমি দেখি নি তবে এই পেশায় যে সে অ্ত্যন্ত সফল সে কথা বলতেই হবে|
মনোজ ভট্টাচার্য
আমাদের বাংলা লাইব্রেরী ! আজ প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে – একটা চালা-ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে ঝড় বৃষ্টির দাপট উপভোগ করার চেষ্টা করছিলাম ! – হে হে – বয়েস যদিও তিনকাল – তবু ভেলপুরির স্বাদ কি ভোলা যায় ! কিন্তু সবার বৃষ্টিতে ভেজার সখ নাও থাকতে পারে ! একেবারে ভিজে যাবার আগে একজন বলল – ওপরে লাইব্রেরীতে গেলে কেমন হয় ! – এটা মন্দ নয় ! চারতলায় একটা লাইব্রেরি আছে বৃদ্ধাবাসের । গেছিও বটে – কিন্তু নিয়মিত যাওয়া হয়ে ওঠে না ! – তো এখন যাওয়া যেতে পারে ! লাইব্রেরীতে এসে দেখি – আপাতত কেউ নেই – আমরা ছাড়া ! বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার ! আছে সাত আটটা বই ভর্তি আলমারি ! বই দেখলেই এখনো কিছু লোকের মনের জিহ্বা লকলকায় – আমিও সেই শ্রেনীর ! পড়ি বা না-পড়ি – তবু মনের ভেতর একটা আত্ম-তৃপ্তির ভাব আসে ! কত রকম বই । ইংরিজি বই আছে বেশ কিছু ! কিন্তু দই রসগোল্লা ছেড়ে লাড্ডু খায় কোন বাঙ্গালি ! বাংলা বই – সে রসকস-হীন ধর্মের বই থেকে, ভুত থেকে রহস্য-ঘন ডিটেক্টিভ বই ! – মানে যাদের নিজেদেরই বাড়িতে ঠাই হচ্ছে না – তাদের সব বই কাগজ-ওলার কাছে যাবার আগে ট্রাঙ্ক-ভরতি হয়ে এখানে জড় হয়েছে ! এখানে যাহক বই পড়ার শেষতম প্রজন্মের কিছু প্রাণী আছে ! আমার বইয়ের ভবিষ্যৎ ঠিকানাটাও দেখা যাচ্ছে এখানেই ! বেশ কটা বই ঘেঁটে দেখলাম! মোটামুটি বাকি জীবনটা কেটে যাবে মনে হয় ! কত রকমের বই ! একেবারে নতুন থেকে ধুলো ধূসরিত – মলাট ছেঁড়া – কিছু বিবর্ণ পাতাও ছেঁড়া - ! তা হোক – তবু তো বাংলা বই ! আবার বেশ কিছু বইও আছে – দুটো করে ! আগে আগে বিয়ে বাড়িতে প্রীতি উপহার এসে যেত একাধিক - দুটো ‘সাগর থেকে ফেরা’ বা তিনটে ‘সুখী দম্পতি’! – এখানেও রয়েছে ‘বাংলার ইতিহাস’ দুটো সত্যজিৎ-সমগ্র দুটো – প্রায় নতুন ! আর আছে সারদা মা বা নানান বাবা বা মায়ের প্রচুর বই ! ও, আবার দেখলাম – কাছাকাছি এক প্রকাশালয় থেকে একগাদা বই প্যাক করে দাতব্য করেছে ! কেনা যখনই হোক – পাতা উলটানো হয়েছে কিনা – সন্দেহ ! বইয়ের মালিকের নাম পর্যন্ত লেখা নেই ! বইয়ের মলাট উল্টলেই লেখা থাকত – ‘শুভর বিয়েতে প্রীতি উপহার – ছোট মাসিমা – ১৯৬০’ – দেখে বোঝা যেত শুভকে উপহারস্বরূপ দিয়েছে তার ছোট মাসিমা – ১৯৬০ সালে ! সে সময়ে উপহার হিসেবে বই দেওয়া রেওয়াজ ছিল ! সেসব দেখেও কিছু আঁচ করা যেত ! এই প্রসঙ্গে বলি – বেশ ছোটবেলায় – পিতামহকে কেউ নিমন্ত্রন জানালে – আমাদের কেউ – দাদুর লেখা একটা বা দুটো বই নিয়ে গিয়ে হাজির হতাম বিয়েবাড়িতে ! – তখন ঐটাই চল ছিল ! বোকা বোকা মুখ করে – খেয়ে বা না-খেয়ে চলে আসতাম ! হ্যাঁ – আমার এরকম অভ্যেস ছিল ! ভিড় ভাট্টা দেখলে – চলে আসতাম । বাড়িতে ফিরে – পেটে খিল মেরে থাকতাম ! মুস্কিল হতো – দাদু যখন জানতে চাইত – কি খেয়েছি ! সেটা আরও যন্ত্রণাদায়ক হতো ! বানিয়ে বানিয়ে বলতাম ! নেমন্তন্য বাড়িতে মোটামুটি একই রকম মেনু হতো ! – কিন্তু পেটে খিল মেরে বানিয়ে বানিয়ে বলা - - ! যাচ্চলে হচ্ছিলো কথা লাইব্রেরির – চলে গেল গরু শ্মশানে ! তবে ছোট্ট লাইব্রেরী দেখেছিলাম – ভার্জিনিয়ায় ! খুব সুন্দর একটা কুঁড়েঘর এর মতন দেখতে ছোট্ট আলমারির ভেতর চারদিকেই সাজানো বই ! ইচ্ছে করলে বই নেওয়া যায় ! কোন লাইব্রেরিয়ান নেই – কোন এন্ট্রি নেই – জমা দেবার নির্দিষ্ট তারিখও নেই ! – আবার ফেরত দেবার সময়েও আলমারির ডালা খুলে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেওয়া যায় ! এই নিয়ে কিছু লিখেছিলাম এখানে ! আপাতত আমাদের এই লাইব্রেরীটাও প্রায় সেই রকম ! – যে কোন বই নেওয়া যায় ! যতদিন খুশি রাখা যাবে – পড়া হলে - গিয়ে রেখে দিলেই হল ! – না দিলেই বা কি হয় ! মনোজ
মনোজ ভট্টাচার্য
হঠাৎ একটা গুল্প মনে পড়ে গেল । - বলবো ? – এটাও একটু বাংলাদেশী ধরনের – ! আর কোত্থেকে যে টুকেছি – তাও মনে নেই ! – ধরা পড়ে গেলে – একটু গাল মন্দ তো করবেন ! আর কি ! এক শহরতলীর পয়সাওলা মাতব্বর ধরনের লোক – তার বাড়ির সামনে কয়েকজন মোসাহেবের সঙ্গে কথা টথা বলছে । দেখে একটা লোক আসছে – তাদের দিকেই । মাথায় একটা এনামেলের বড় হাঁড়ি । অ্যাই – তুই কে রে ! মাতব্বর জিগ্যেস করে । - মাথায় কি আনছস ? আজ্ঞে হুজুর আমি লতিফ । - আপনে আমায় সিনবেন না ! – আপনার বাড়ি থেকে এই পাতিল খান নিয়ে গেসলাম – ফেরত দিতে আসলাম ! এত বড় পাতিল তুই আমার বাড়ি থেইক্যা নিয়া গেছিলিস ? কবে ? – মাতব্বর হেসে তার লোকেদের দিকে তাকিয়ে বলল – আমি তো জানিই না আমার বাড়িতে এত বড় হাঁড়ি-পাতিল ছিল ! আপনি হুজুর বড় মানুষ । হাজার কাজে ব্যস্ত – আপনের কি এসব ছোট কথা মনে থাকবে ? – ফেরত দিতে অনেকদিন দেরি হয়ে গেল ! – লোকটি সেই হাঁড়িটা নিচে নামাতে দেখা গেল হাঁড়ির ভেতর ছোট একটা একই রকমের এনামেলের হাঁড়ি ! ওটা আবার কি রে ! মাতব্বর জিগ্যেস করে রসিকতা করে – বাচ্চা নাকি ? ঠিকই কইসেন কর্তা ! – অনেকদিন হইয়া গেসে – তাই বাচ্চা হইয়া গেসে ! – তা ভাবলাম – হাঁড়িটা তো আপনের ! তো বাচ্চাটাও আপনের হইব ! মাতব্বরের স্যাঙ্গাৎদের তো মাথা ঘুরে গেছে ! এনামেলের হাঁড়ির আবার বাচ্চা হয় নাকি ! – এই লোকটা খুব সৎ বলতেই হবে ! ছোট হাঁড়িটা নিজে ঝেঁপে না দিয়ে – ফেরত দিতে এসেছে ! ওদের মধ্যে এনায়েত মাতব্বরকে খুব নিচু স্বরে বলল – কর্তা ! আপনার বাড়িতে তো একখান টি ভি ! – সেটা তো গিন্নি মা-ই সারদিন দেখেন ! – আমরা তো একদম খেলা দেখতে পাই না ! – এই টি ভিটা ওকে দিন না ক্যান ! ওটার বাচ্চাটা যা হবে তাতেই আমরা খেলা দেখতে পারব ! সেই শুনে অন্য স্যাঙ্গাৎরাও একটু উৎসাহিত হয়ে উঠল ! কিন্তু এই ব্যাটা যদি এতবড় টি ভি টা ফেরত না দেয় ! মাতব্বর একটু দোনা মনা করতে লাগলো ! শুনে আরেকজন বলল – আরে এ বেটা লতিফকে কে না চেনে ! ও সবার জিনিস সারিয়ে দেয় ! অ্যাই লতিফ না কি জ্যান – আমার এই টি ভি খান সারায়ে দিতে পারস ? এটার একটু অসুখ হইসে ! লতিফ টি ভি টা দেখে বলে – কর্তা – এত অনেক বড় টি ভি ! এইডা সারাতে অনেকদিন লাগব ! – আপনার লোকেদের বলেন না ক্যান – এগটু এগিয়ে দিয়ে রিস্কায় বসিয়ে দিয়ে আসতে ! লতিফ তো রিক্সায় করে টি ভি নিয়ে চলে গেল ! – দিন চলে যায় – মাস চলে যায় । অনেক মাস হয়ে গেছে – ওদিকে লতিফেরও কোন খবর নেই ! একদিন মাতব্বর রেগে মেগে ওর স্যাঙ্গাৎদের বলল – যেখান থেকে হোক লতিফকে মারতে মারতে ধরে আনে । স্যাঙাতরা লতিফকে খুঁজে বের করে আচ্ছা করে মারতে মারতে একেবারে কর্তার সামনে এনে ফেলল ! রাগের চোটে মাতব্বরও বেশ কয়েকটা লাথি কষিয়ে দিল । তারপর বলল – ব্যাটা ভেবেছিলিস – আমার টি ভি মেরে দিবি ! – একটা টি ভি সারাতে কতদিন লাগে ? লতিফ তখন প্রায় মরো মরো – তারই মধ্যে কেঁউ কেঁউ করে যা বলল - ! – সেই টি ভি প্রসবের সময় যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে মরে গেছে ! আরে অত বড় টি ভি কখনও স্বাভাবিক প্রসব হয় ! ওকে সীজার করালি না কেন ! লতিফ বলল – সে সীজার করাবার জন্যে ডাক্তার ডেকেছিল । কিন্তু ডাক্তার তো আগে কখনও টি ভির সীজার করেনি – তাই সেটা একেবারে ভেঙ্গে ফেলেছে ! – ও নিজেই আসছিল কর্তার কাছে শোক সংবাদ নিয়ে – কিন্তু তার আগেই এনারা গিয়ে ওকে এমন মার দিয়েছে – যে - - ! সবাই গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে বসে রইল ! একটা আস্ত টি ভি মরে গেল !
মনোজ ভট্টাচার্য
কাল একজনকে – অবশ্যই কোন ছাত্রকে - বলতে শুনলাম – স্যর একটু পায়ের ধুলো দেবেন ! খুব দ্বিধায় পড়ে গেলাম ! পায়ের ধুলো দেবটা কি করে ? পায়ের ধুলো কি জল নাকি যে – ঘর থেকে এক গেলাস জল এনে দেবো ! আবার আমরা কেউ বাড়িতে পায়ে ধুলো-কাদা নিয়ে থাকিও না – যে পা থেকে ধুলো ঝেড়ে দেবো ! – অনেকে এ কথাও বলে বটে – বাবার পায়ের একটু ধুলো আনিস – যা লাগে দিয়ে দিস ! – যা লাগে দিয়ে দিস – কথাটার মানে কিন্তু ভালোই বোঝা যায় ! ওটা অর্থনীতির অংশ ! দ্বিতীয়টা ? অবশ্য শুনেছি আজকাল নাকি প্যাকেটে করে বাবাজি বা মাতাজি দের পায়ের ধুলো পাঠানো হয় – দেশ-বিদেশের ভক্তদের ডেলিভারির জন্যে ! কিন্তু কখনো চাক্ষুষ হয় নি – প্যাকেটের ভেতর সত্যি কি থাকে ! তবে সত্যি কেউ কি আশা করে রাস্তা থেকে ধুলো এনে প্যাকেটে ভরে বিক্রি করছে ? তবে ছাত্রাবস্থায়ে দুবার মাধ্যমিকে ফেল করার পরে মা নিয়ে গেল শালকিয়ায় এক ১০১ সাধুবাবার কাছে । অনেক প্রনামী ও অনুরোধের পরিবর্তে সেই ১০১ বাবা একটা মাদুলি দিলেন । - রোজ সকালে এটা কপালে ঠেকাবি । পাশ করলে গঙ্গার জলে ভক্তিভরে ফেলে দিবি । - ফেল করলে এটা নিয়ে আবার আসবি । ফেল করে শ্রীল বাবার কাছে যেতে – দেখা গেল মাদুলির ভেতর ছোট্ট কাগজে ‘ফেল’ কথাটা লেখা আছে বটে ! – কিন্তু সে তো ভাগ্যের ‘লেখা’ ! ধুলোর ব্যাপার নয় ! কিন্তু আমার ধারনা – পায়ের ধুলো মানে – কমন্ডুলুতে রাখা অথবা পুজোর কোন পাত্রে জলের মধ্যে – গঙ্গার জল হলেও চলে – একটা গাঁদা ফুলের ছোট্ট একটা টুকরো মেশানো । আশীর্বাদক বা পাদোদক ! এর আরেকটা নাম চরণামৃত – সেটাই কপালে ঠেকিয়ে মুখে ঠেকানো ! কিন্তু ঠিক মিলছে না ! সবাই বলে চরণামৃত পান করেছে! কেউ তো বলে না ‘পায়ের ধুলো’ পান করেছে ! এবার আমার যা বুদ্ধি – সেই অনুসারে ব্যাখ্যা করি । একটা স্ট্যাটিউটরি সাবধানবানী দিচ্ছি - ব্যাখ্যা কিন্তু অনেকেরই পছন্দ হবে না ! পায়ের ধুলো বললে – সেই ধুলোর একটা ওজন – যত কমই হোক আশা করা যায় । অন্তত এক গ্রাম – বেশি হলে ভক্তরা অখুসী হবে বলে মনে হয় না ! ডাক যোগে পাঠানো হবে বলে কথা ! – আমরা প্রথমে যখন আমেরিকা যাই – তখন আত্মীয়দের অনুরোধে – উদ্ভট সব জিনিস নিয়ে যেতে হয়েছিলো । লুচি বেলার যন্ত্র থেকে নানান রকমের মাদুলী ইতাদি – এবং বাঘ-নখ নামে কিছু ! সে পদার্থটা যে সঠিক কী – এখন আর মনে পড়ে না ! লুচি বেলবার যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার হয়েছে বলে মনে হয় না । কিন্তু তার একটা ওজন ছিল । সেটা আবার প্লেন ভাড়ার সঙ্গে যোগ হয়েছিলো – যত কমই হোক ! ২০২১ সাল নাগাদ কোথা থেকে করোনা বলে এক উৎপাত এসেছিল । তারই হাত থেকে বাঁচবার জন্যে প্রতিষেধক নিতে হল । একবার নয় দু-বার । তখন ইঞ্জেকশান ব্যাপারটা একটা সোশ্যাল স্ট্যাটাসে পরে গেল ! কারুর সঙ্গে দেখা হলে – প্রথমেই জিগ্যেস করে – ইঞ্জেকশান নেওয়া হয়েছে ? – না বললেও বিপদ , হ্যাঁ বললেও বিপদ ! – না বললেই প্রায় হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ইঞ্জেকশান নেওয়ার উপদেশ দেবে । হ্যাঁ বললে – তাদের কেন নেওয়া হয় নি ত্র কাহিনী শোনাবে পরবর্তী সময়টা ! - ইঞ্জেকশান টিঞ্জেকশান নিতে আমার ঘোরতর আপত্তি থাকলেও আমার স্ত্রীর খুবই উৎসাহ । অতএব রোদ্দুর ভীড় - মাথায় নিয়ে ভয়ে ভয়ে সেই ভয়াল ইঞ্জেকশান নিতেই হল । বাঘের হাত থেকে বাঁচতে পড়লাম গিয়ে কুমীরের সামনে ! কি যেন কথাটা – ঝালের হাত থেকে পালাতে গিয়ে তেতুলতলায় বাস ! – সেই প্রাথমিক পর্যায় কোন ডাক্তার বৈজ্ঞানিকই জানত না কিসে কি হয় ! – দ্বিতীয় ডোজে নাকি চুলকানি হতে লাগলো ! – কেউ বলল – এটা সাধারন চুলকানি – কেউ বলল এটা প্রতিষেধকের বাই প্রোডাক্ট ! কেউ বলল এলার্জি ! – কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত হলাম – একদিন টি ভিতে একজন বিশেষজ্ঞ রায় দিলেন – দ্বিতীয় ডোজের ফলে এক ধরনের এলার্জি চুল্কানির আকারে এসে গেছে ! অতয়েব আমার সেই দ্বিতীয় ডোজের ঠেলা সামলাতে – দিনের পর দিন ডাক্তার ওষুধ আর চুলকানি ! ওষুধ – খাবার ও গায়ের ক্রীম, সাবান ও বেগুন খাওয়া বন্ধ । কেউ বলল গায়ে তেল লাগিও না কেউ বলল – কেউ বলল তেল লাগাও ! ক্রমশ সেই আবিষ্কারটা পরিষ্কার হয়ে যেতে আরম্ভ করলো ! চুলকাতে চুলকাতে পায়ের থেকে মরা চামড়ার পাপড়ির টুকরোগুলো যাকে বলে ‘মরা মাস’ পড়তে লাগলো । পনেরো মিনিট ধরে চুলকালে মেঝেতে অনেকটা পরিমান সাদা হয়ে যায় – সেগুলো জরো করলেই মোটামুটি - ! আমি এখন তক্কে তক্কে আছি – কেউ পায়ের ধুলো চাইলেই – যে ধুলোগুলো জমিয়ে রেখেচ্ছি- সেখান থেকেই – না-হয় - ! দেখতে চাইছি পায়ের ধুলো প্রকাশ হয় কিনা - - !
মনোজ ভট্টাচার্য
‘ওঁরা বাড়ি ফিরলেন কফিনে ‘! কী মর্মান্তিক খবর ! – এই দুর্ধর্ষ দুঃসাহসিক পর্বতপ্রেমিক অভিযাত্রিকদের জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম ! শুধু্মাত্র পাহাড়কে ভালবেসেই তাদের এই আত্ম-বলিদান ! আমাকে অনেকবার এই প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে । পাহাড় না সমুদ্র ? – আমার কিন্তু পাহাড়কেই বেশি ভালো লাগে ! পাহাড়ে কত নদী - হেসে হেসে নেচে নেচে সুধাতে চায় – কত কথা ! তারাও অতো উঁচু পাহাড় থেকে নামতে নামতে সমুদ্রে মিশতে চায় ! আর সমুদ্রে মিশে গেলেই হয়ে যায় সাগর ! তখন কোথায় থাকে সুন্দরডুঙ্গা নদী – কোথায় থাকে ডংলু নদী ! পাহাড়ের মজা হচ্ছে – নদীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলা যায় ! এই চলেছে পাশে পাশে – ঠিক বন্ধুর মতো ! আবার হঠাৎ কোথায় একেবারে নীচে ! তখন আবার তার রূপ দেখলে ভয় ভয় করে ! – যদি পড়ে যাই ও-ই নীচে - - ! এক সময়ে আমিও কয়েক যায়গায় ট্রেকিং করেছি ! তখন আমরা সবাই মধ্যবিত্ত আয়ের সীমায় নিজেদের তাগিদে ও চেষ্টায় ট্রেকিং করতাম । না ছিল কোন ট্রেনিং, না ছিল যথাযথ সরঞ্জাম ! এমন কি জুতোও ! – পড়ে শুনেছি ট্রেকিং ও এক্সপিডিশানের জন্যে কিছু কিছু অর্থ সাহায্য দেওয়া হয় ! তা সে সব কিছু তখন জোটেনি ! আর ছবি ? ট্রেকিংএর যে ছবিগুলো – তাও সাদা কালো । সুন্দরডুঙ্গা যাবার আগে ইচ্ছে হল এবার অন্তত একটা রঙিন ৩৫ মি মি ফিল্ম নিয়ে যাবার ! পাহাড়ের যে রূপ হয় – তা শুধু মুখের বর্ণনায় কিছুই বোঝানো যায় না ! – তাই চৌরংগির দোকানে গিয়ে দর করে পালাবার পথ পাই না ! তখনই এত দাম ! আমাদের সাধ্যের বাইরে ! - অথচ পরে দেখেছি – পিন্ডারি গ্লেশিয়ারের ছবি কি দারুন দেখায় ! বা অন্যান্য ছবিও কত সুন্দর ! আমাদের ছ জনের জন্যে দরকার ছজন পোর্টার – কিন্তু আমাদের খরচ কুলোবার জন্যে তিনজন পোর্টার নিতে হল ! অন্তত দশ দিনের রেশন ! এইসব নানাধরনের খরচ ! এইসব বিবরণ দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য – শুধু পাহাড়কে ভালোবেসে – সাধ্যের বাইরে গিয়েও যে ধরনের ক্রিচ্ছসাধন করে অভিযাত্রীরা যায় – খানিকটা যা হয় হবে – মনোভাব নিয়ে – সেটাও তো আত্মবলিদাণ ! – এর ওপর হঠাৎ যদি ঝড় ওঠে – পাহাড়ের ওপর ঝড় – কোথাও কিছু নেই অবলম্বন করার – আর পোর্টার যদি এগুতে না চায় - ? তখন বেশ জেদাজেদির মেজাজ এসেই যায় – অবিশ্বাসের প্রশ্নও আসে ! - পোর্টার কি আরও বেশি দিন চার্জ করবে ? এই সময় পত্রিকায় এক লেখিকা খানিকটা এই ধরনের বক্তব্যই রেখেছেন ! এমনকি পোর্টারদের সঙ্গে জেদাজেদির কথাও লিখেছেন ! – আবার এক পরিবার তাদের ছ বছরের এক বাচ্ছাকে নিয়ে ঐ রাস্তায় যাওয়ার কথা লিখেছেন ! – মনে হয় ওকে বোঝানো হয় নি – পর্বতারোহণ ব্যাপারটা ঠিক এক্কা দোক্কা খেলা নয় ! আমার পাহাড় যাবার নেশা কাটল – সুন্দরডুঙ্গায় – পাহাড়ে হড়কে গিয়ে ! – মরি নি । একজন পোর্টার কোত্থেকে আমার পায়ের তলায় এসে আমাকে আটকে দিল ! বাঁচিয়ে দিল ! এই লেখাটার জন্যে দু রাত্তির ঘুমোতে পারিনি । যারা প্রান দিয়েছেন – তাদের জন্যে কি কিছু কৃতজ্ঞতাও জানাতে পারি না ! মনোজ
মনোজ ভট্টাচার্য
বানপ্রস্থ মানে বৃদ্ধাবাসের আশ্রয়ে ! বেশ কয়েক বছর খোঁজাখুঁজির পর একটা ঠাই পাওয়া গেল – ‘আরতি প্রিন্সেস নেস্ট’ , কোন্নগর হুগলী ! দাদাঠাকুরের – ‘এটা-কোন-নগর’ ! – আগে আগে কলকাতার লোকেরা কাশী যেতে না পেরে – ‘গঙ্গার পশ্চিম কূল – বারানসী সমতুল’ – বলত! তো আমরাও সেই প্রকার ‘বার্ধক্যে বারানসীতেই’ আছি – বলা যেতে পারে । আমরা বৃদ্ধাবাসে কেন ? এটা গভীর প্রশ্ন ! আমি একটা খুব প্রতিক্রিয়াশীল লেখা আগে লিখেছি – বাড়ির সাহায্যকারীদের সম্বন্ধে । বাড়িতে দুজন লোক রাখা হলেও – ছুটি থাকা সত্বেও এদের প্রতি সপ্তাহে অবিরত কামাই অন্যদের কতটা অসুবিধে হয় জানিনা – কিন্তু আমাদের মতো অথর্ব মানুষদের পক্ষে শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব কঠিন হয়ে পরেছিলো । অগত্যা বৃদ্ধাবাস ! – এখানে এসে দেখি – সমস্যা শুধু আমাদেরই নয় – সবারই সেই সমস্যা ! – এখানে যারা এসেছেন – তারা কিন্তু সংসারে উদ্বৃত্ত মা-বাবা নন । মোটামুটি সবাই স্বেচ্ছায় ও সসন্মানে বাকি জীবনটা কাটাবার জন্যে ! সংসার সংসারে রেখে এসে জীবন যাপন করা ! আমার চিরকালই অভিমত – মানুষকে চিনতে হলে তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে । সবার সঙ্গে মিশলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পরস্পরের জানা-পরিচেনা হয় ! বিশেষ তাদের সম্বন্ধে লিখতে হলে তো বটেই ! – সে লেখা তো ফ্যান্সি লেখা ! - আগে আগে বৃদ্ধাবাস সম্বন্ধে নানারকম ভাল-মন্দ মতামত কানে আসতো । বৃদ্ধাবাসে নাকি ঠিকমত খেতে দেওয়া হয় না ঠিকমতো । ওখানে আয়ারা প্রবীণ বাসিন্দাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ! – আমরা বেশ কয়েকবছর ধরে বৃদ্ধাবাস-গুলোতে যাতায়াতের ফলে কোথাও এই অভিজ্ঞতাগুলো চোখে পড়েনি । - আমাদের অনেক বৃদ্ধাশ্রমেও যেতে হয়েছে । অবশ্য বৃদ্ধাশ্রমের মতো বৃদ্ধাবাসগুলোকে কোন মিশন বা ট্রাস্ট এর দাক্ষিণ্যে পরিচালনা করতে হয় না ! এ যাবত কাল অনেক দেব দেবীর নাম শুনেছি তার মধ্যে সিঁথিতে মা-তারা নাম দেখেছি প্রায় সব কটা দোকানের ! – কিন্তু তারাপীঠ ছাড়া তারা মার পুজা কখনো কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়েনা ! এখানে দেখি সেই তারা মার পুজো হচ্ছে । দস্তুর মতো মূর্তি এনে ! পুরোহিত এসে পুজো - কত রাত পর্যন্ত জানি না - কিন্তু প্রসাদও হয়েছিল পরেরদিন সকালে ! প্রসাদে আমার কোনদিনই আপত্তি নেই ! এখানেও একটা গল্প আছে যেমন সর্বত্রই থাকে আরকি ! এই পুজোটা একটা ব্যক্তিগত পুজো ছিল । তবে এখানে সব কিছুই সার্বজনিক ! একবার প্রতিমার পেতলের ঘট নাকি ভুল করে বা রাগ করে – কেউ পুকুরে ফেলে দিয়েছিল ! পরের দিন পুরোহিত সেটা খুঁজে না পেলে হুলুস্থুল পড়ে যায় ! পুরোহিতের বিধান অনুসারে – পুজোয় বিঘ্ন ঘটায় বন্ধ হয়ে যায় ! প্রায় তিন বছর বন্ধ ছিল । - তা পুজো বন্ধ থাকলে চলে ? ঘট তার নিজের দরকারেই জানান দিল । রীতি অনুসারে স্বপ্নে নয় ! পুকুর ছেঁকে মাছ তুলতে গিয়ে পাওয়া গেল – সেই পেতলের ঘট ! – এদিকে এই তিন বছর নাকি ব্যবসায় খুব ক্ষতি হয়েছে ! তাই আবার চালু হল – তারা মাইকী জয় । আসছে বছর আবার হবে ! তা হোক – প্রসাদ তো পাওয়া যায় ! আগে যখন এখানে দেখতে এসেছিলাম মাস ছয়েক আগে – দুদিন থেকেছিলাম । সেই সময়ে পাশের বাড়ির এক অবসরপ্রাপ্ত ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয়েছিলো । রাজ্য সরকারি কর্মচারি – এখন পেনশান পান । - উনি নিজেই ওনার সাংসারিক অবস্থার কথা গড়গড় করে বলে গেলেন । দুই ছেলে – এক ছেলে রাজ্য সরকারে কাজ পেয়েছে । আর ছোট ছেলে এম এ পাশ করে – টেট পরীক্ষায় পাশ করে অপেক্ষা করছে – কবে চাকরি হবে । ইতিমধ্যে টুইশানি করে যা রোজগার হয় ! একেবারে বসে না থেকে – যেটুকু হয় ! এখন তো শুধু খেলা হচ্ছে ! সবাই খুব ব্যস্ত ! তিনিই বলেছিলেন – এই বৃদ্ধাবাস সম্বন্ধে । কজন এসেছে – কজন ইতিমধ্যেই চলে গেছে ! – এখানে আমরা কদিন থাকবো, ইত্যাদি ! – বলতে যতটা আগ্রহী – শুনতে ততটা নন ! – সেই হেন ভদ্রলোকের সঙ্গে আবার আলাপ হল ! ঝাঁ-জি হল এখানকার দারোয়ানজি ! উত্তরপ্রদেশের লোক – মিলিটারিতে কাজ করতেন – আসামের ওদিকে অনেকদিন ডিউটিতে ছিলেন ! তারপর পায়ে চোট খেয়ে বসে গেছেন । এখানে লেগে আছে ! কারুর ওর মোটা গোঁফের তলা দিয়ে আসবার বা যাবার উপায় নেই ! দু-তিনবার চেষ্টা করেছি – কিন্তু জানিয়ে যেতে হবে ! কারন অনেকে আছেন – ঠিক ঠাক নাও চিনতে পারে ! আমাকেও সেই দলে ফেলে হয়ত ! পনেরোই আগস্ট সকালে এখানে অনুষ্ঠান হয় ! সবাইকেই যোগ দিতে হয় । শুধু লাল কেল্লার বক্তিমেই নয় – দেশাত্মবোধক গান আবৃতি বা যা হয় কিছু-মিছু ! – আমি তো চিরকালই ব্যাক-বেঞ্চার । বিশেষ এসব গুরুগম্ভীর ব্যাপারে কোন জ্ঞানই নেই ! তা বললেই কি হয় ! – কে যেন বলেছিল একবার – আমার চুল দেখেই চেনা যায় ! যত পেছনেই থাকি না কেন – প্রথমেই ডাক পরে আমার ! কি মুস্কিল ! স্বাধীনতার স্বাদ বুঝতে বুঝতেই তো জীবন শেষ ! আমি আর কি বলবো ! কিন্তু যেটা দ্রষ্টব্য সেটা হল – আমাদের – ঝাঁ-জি একটা গান গাইলেন ! সে তো ভালো কথাই ! সুর তাল ছিল কিনা মনে নেই - কিন্তু গানের মধ্যে সিয়ারাম ও হনূমান দের নাম শুনলাম ! হয় তো সীতাকে নিয়ে যাবার সময়ে আমাদের স্বাধীনতাটা ঝপ করে দিয়ে গেছিলো ! আমার তো হনূমান চালিশা পড়া নেই তাই –ঠিক বলতে পারলাম না – অথবা কোন মোদী কতবার শহীদ হয়েছে ! এখানেই একজনের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল । কি করে ? ‘বোমা’ থিয়েটার আমরা দেখেছি বলে ! আর তাতে অরবিন্দকে – কিভাবে দেখান হয়েছে ! এই ব্যাপারে নাটকের সত্যতা নিয়ে অনেক আলোচনা হল ! - গুগুলে দেখলাম – কি এক দুর্ঘট বিষয় নিয়ে পড়াশুনা ও অধ্যাপনা করতেন ! – সে হল – কিন্তু তারপর কি করছেন ! বছর আস্টেক অবসর নিয়েছেন – কিন্তু সঠিকভাবে কিছুই করেন না ! বাড়িতে মা আছে, দাদা আছে । কিন্তু একেবারে ঝামেলামুক্ত মানুষ ! কোন ঝামেলায় থাকবেন না বলে – এখানে এসেছেন ! দোকান বাজার বিল পেমেন্টের মধ্যে নেই ! ঘরের মধ্যে ছোট্ট বাক্স থেকে জ্ঞান আহরণ করেন ! কোথাও যান না ? না মশাই, নিজের দেহকে আর কষ্ট দেওয়া কেন ! বিশেষ করে ঐ গুগুলেই যদি সব খোঁজ পাওয়া যায় ! – আচ্ছা, রোমের কলাসিয়ামের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হয় না – এইখানে একদিন সম্রাটের নির্দেশে কত গ্ল্যাডিয়টরদের সিংহের সঙ্গে লড়তে হত । অথবা গ্ল্যাডিয়েটরদের নিজেদের সঙ্গে লড়তে হতো – কোন শত্রুতা না থাকলেও ! শরীরের মধ্যে একটা উত্তেজনা হতো না ! স্পারটাকাস ! - – সে তো মশাই এখনও সৈন্যদের দেশের নাম করে – অন্য দেশের সৈন্যদের মারতে হয় – সরকারের নির্দেশে ! – রোমে হতো সম্রাটের বিলাসিতায় ! আর এখন ? এরাও তো স্পারটাকাস ! এরা তো অনেক কাছের ! - - এ তো বেশ মুশকিল ! কি যুক্তি দেখাবো ! দেশ টেশ বলে কিছু আছে তো ! – তা এই নিয়ে বার তিনেক দেখা হল ! আর যতবারই কথা হয় - প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে যায় ! – প্রসঙ্গত ইনিও ভট্টাচার্য ! ভট্টাচার্যরা যেমন হয় আর কি !
Aloka
লক ডাউনের অভিঘাত : চেনা মহলের হালচাল .| আজকে . দুধ নেই বললেন যে দোকানে দুধ নিতে যাই তার মালিক.| ভদ্রলোক মাঝবয়সী ‚ একটা বহুতলের একতলার অর্ধেক তা জুড়ে দোকান | আমূল এর এজেন্ট দুধ ছাড়াও আমূল এর সব কিছু বিক্রি করেন | আমি যে দুধ্তা নিই সেটা দিতে পারলেন না| খুব আক্ষেপ করছিলেন বিক্রি খুব কমে গেছে.| কি করবে লোকের হাতে পয়্সানেই আমিও কম করে কিনি| জিগ্গেস করি আপনার যারা নিয়মিত কাস্টোমার সেই স্ংখ্যাটা কি কমেছে বললেন বেশ কিছু কমেছে| বেশ চিন্তিত দেখলাম| আমাদের আরতি| অনেক্গুলো বাড়ীতে ঘর মোছা বাসন মাজার কাজ করে| একটা বাড়ীর কাজ চলে গেছে আর একটা বাড়ীতে ওকে একদিন করে আসতে বলেছে | ওর ছেলে একটা কারখানায় কাজ করত| কারখানা বন্ধ | ওরও রোজগার নেই| মেয়ে জামাই য়ের স্টেশনে দুটো আলাদা স্তল আছে একজন পান বিক্রি করে আর একজন সকালে রুতি তরকারী বিক্রি করে| ট্রেন চলছে না ওদের দোকান বন্ধ| হাসিখুশী আরতির মুখে এখন আষাঢ়ের মেঘ জমে থাকে আমার স্নেহভাজন একটি পরিবার... ছেলেই বলি.ছোট থেকে দেখছি‚‚‚‚‚পাঁচের ঘরে বয়্স.একটি বেসরকারী স্ংস্থার একাউন্ট্সে এ কাজ করে| বাড়িতে বউ আর ওষুধ নির্ভর বৃদ্ধা অসুস্থ মা | ইদানীং কালে ফোনেই খবরাখবর দেওয়া নেয়া হয় | ওর বৌ‚ মিতাই যোগাযোগের কাজটা করে থাকে| তা বেশ কিছুদিন আগে তখনো যানবাহন চালু হয় নি কিন্তু অফিস খোলা| জিজ্ঞাসা করলাম সোনা ‚ ছেলেটি | .অফিস যাচ্ছে ? ..বালিগন্জ ফাঁড়ির ওখানে ওর অফিস সেটা জানতাম| বলল যাচ্ছে না গিয়ে ত উপায় নেই যেতেই হচ্ছে| তিনজন মিলে একটা গাড়ি ভাড়া করে যায় দুশো টাকা করে লাগে কোথা থেকে দেব বল তো‚ কি করেই বা স্ংসার চালাব এই ভাবে কতদিন চলবেজানি না| খুব চিন্তায় আছি| আমারই মনটা খারাপ হয়ে গেল| কি ই ই বা করতে পারি| হিমু‚ এই নামেই জানি এই বছর চল্লিশেক ব্য়স | মর্কেতের ভেতর মেয়েদের পোষাকের একতা ছোট দোকান আছে‚ | বাড়িতে দাদা বৌদির সন্গে থাকে | বাড়িতা ভাড়ার| দাদা একটা ছোট্খাট কাজ করত|সেই কাজটা চলে গেছে| ওরও ত দোকান বন্ধ| এখন বাড়িতে ও আর ওর বৌদি মিলে বিকেলে রুটি তরকারি তৈরী করে পাড়ায় হোম ডেলিভারি করে| বড় রাস্তার ওপর ছিল আয়তনে বেশ বড় একতা মোবাইলের দোকান| সব ব্র্যান্ডের মোবাইল বিক্রি হ্ত কারন জানি না হঠাৎই দেখি সেটা তিন টুকরো হয়ে গেল এক টুকরো হল SRL Diagnostic.s আর একটা সোনার দোকান মাঝ খানের টুকরোতা সেই মোবাইলের দোকান বন্ধ হয়ে পড়ে আছে| এই বছর খানেকের মধ্যেই এটা ঘটেছে| রাস্তার ধারে ধারে বেশ কয়েকতা রোলের দোকানের টিনের গায়ে আঁকাবাকা অক্ষরে লেখা গরম রুটি তরকারী হোম দেলিভারী দেওয়া হয় | ফোন নম্বর দেওয়া আছে| বুঝি বিকল্প আয়ের রাস্তা খোঁজা| খবরের কাগজের সন্গে প্রায়ই পাই পাতলা লাল নীল কাগজে ছাপা হোম ডেলিভারি দেয় এমন ব্যক্তি ‚ স্ংস্থার নাম আগেও ছিল তবে ইদানীং অনেক বেড়ে গেছে | আগে সাধারনত দুপুর আর রাতের খাবার দিত এখন অনেকে সকাল / বিকেলের খাবার ও দেয়| পাড়ার একটু ভেতর দিকে একদিন ঘুরতে গিয়েছিলাম | বেশ কয়েকটা বাড়ীর গেটে দেখলাম বিজ্ঞাপন ঝুলছে রাত্রে রুটি তরকারি হোম ডেলিভারী দেওয়া হয়| এটা কখনো কম্পিউটার প্রিন্ট আউটে কখনো হাতের লেখায়| আগে কোনদিন দেখিনি বাড়ী গুলো পুরনো . দুটো বাড়ী ত দোতলা বেশ ছিম ছাম... বাইরে থেকে দেখে ত সম্পন্ন মনে হয়| কি জানি কোন দুর্ভাগ্য তাদের বিকল্প আয়ের পথ খুঁজতে বাধ্য করেছে| মোবাইল টা গন্ডগোল করছে| গেলাম পাড়ার দোকানে দেখাতে| দোকানটা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইল বিক্রি হয়‚ সারানো হয়| বেশ কয়েকজন কাজ করে| সব সময় জম জমাট থাকে| ত সেদিন দেখি মালিক ছেলেটি একা বসে কি সব খুট্খাট করছে| কি হয়েছে জানতে চাইল| বললাম| বলল একটু দেরী হবে| ইতিমধ্যে আর দু একজন এল তাদের বলে দিল হবে না‚ লোক নেই| আমাকে বলল কি করব বলুন তো ভালো কাজ জানা লোক রাখতে গেলে যে টাকা দিতে হয় সেটা এখন আয় হচ্ছে না | সেই ২০০১ থেকে এই ২০২০ পর্জন্ত একই কমিশন.. এই রকম ভাবে চলে ( কে কমিশন টা দেয় ‚ কাকে দেয় সে সব জানি না )‚এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে গেল| বুঝলাম যতটা না আমাকে বলার জন্য তার থেকে বেশী ক্ষোভটা উগরে দেবার জন্য| আরও বলল স্টেশন থেকে চৌমাথা পর্জন্ত অন্তত ৩০টা মোবাইলের দোকান ছিল এখন কতগুলো আছে দেখবেন ত| ও বলার পরে মনে হল তাই তো৩০টার কথা জানি না তবে তিনটের কথা জানিই উঠে গেছে বলে| আরও জানলাম যতক্ষন না গভর্নমেন্ট পলিসি পালটাচ্ছে ততক্ষন কিছ্ছু হবে না| কৌতূহলী হয়ে জিগ্গেস করি যাদের দোকান উঠে গেল তারা কি করছে.|উত্তর এল যে যা পারছে করছে.|কেউ হোম ডেলিভারি দিচ্ছে‚ কেউ দোকানে কাজ করছে ..| উল্টোদিকে বাংলা সিনেমায় আগে যেমন দেখা যেত বাড়িতে কারুর বিয়ে হলে স্যাকরার ডাক পড়ত.|সে বাড়িতে এসে অর্ডার নিয়ে যেত প্রত্যেক পরিবারেরই এরকম বাঁধা স্যাকরা থাকত| শুধু সিনেমা না আমার জীবনেই আমি দেখেছি|বড় বড় সোনার দোকান ছিল মোটামুটি বৌবাজার কেন্দ্রিক| রেদিমেড গয়্না কেনার তেমন চল ছিল না| আমাদের পাড়ায় যেমন দেখেছি দুটি সোনার দোকান ছিল | এখন সেখানে নাগালের মধ্যে নামী প্রতিষ্ঠিত তিনটি দোকান | এ ছাড়াও স্থানীয় দোকান বেশ কয়েকটি| তবে লক্ষ্য করলাম গত এক দেড় বছরের মধ্যে বড় রাস্তার ওপরে বেশ অনেক্গুলো সোনার দোকান খুলেছে| তরতম থাকলেও প্রত্যেকটাই বেশ জাঁক্জমক পূর্ণ....|ঐ সোনার দোকান যেমন হয় আর কি. কেনা বেচা কি হয় না হয় জানি না তবে এই দুঃসময়ে এতগুলো সোনার...|কি রকম প্যারাড্ক্স মনে হল| তবে ব্যবসার ব্যাপার আমি ত আর বুঝি না..যারা খুলেছে তারা কি আর না বুঝে খুলেছে আর হ্যাঁ পাড়ার সব চেয়ে পুরনো দোকানটা দেখলাম সোনার পাশাপাশি একজন জ্যোতিষীকে বসিয়েছে আর স্টোনের ব্যবসা শুরু করেছে ******************* লেখাটা বেশ কিছুদিন আগের.|পোস্ট করা হয় নি| অব্স্থা এখন একটু পালটেছে.| যানবাহন চলা চল শুরু হয়েছে.| দোকান পাটও খুলছে তবে এই অভিঘাত ত আর সহজে যাবার নয় তাই সাত পাঁচ না ভেবে পোস্ট করেই
শিবাংশু
১৯০৫ সালের পয়লা সেপ্টেমবর শিমলা থেকে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে ষোলো'ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ আইন কার্যকর হবে। প্রতিবাদে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে তেসরা সেপ্টেম্বর বিশাল সভার আয়োজন হয়। সেখান থেকে চার হাজার জনের অধিক জনতা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে বাগবাজারে পশুপতিনাথ বসুর বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলো। কবি নিজে তখন গিরিডিতে। কিন্তু কলকাতার প্রতিবাদের ঢেউ গিরিডিতেও পৌঁছে গিয়েছিলো। কবি সেখানে বসেই বাইশ-তেইশটি স্বদেশী গান রচনা করেন। সাতাশে সেপ্টেম্বর কলকাতার সাবিত্রী লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠেয় প্রতিবাদ সভায় যোগদান করতে তিনি ফিরে এসেছিলেন। এই সভায় বাংলার বিশিষ্টজনেরা দেশভাগের প্রতিবাদে 'রাখীবন্ধন' পালন করার সিদ্ধান্ত নেন। সরলাদেবীর বিবাহ উৎসবে যোগ দেবার জন্য কবিকে আবার গিরিডি ফিরে যেতে হয়। কিন্তু আবার দ্রুত ফিরে আসেন এগারো'ই অক্টোবরে আহ্বায়িত বিজয়া সম্মিলনীতে যোগদান করতে। এই সভায় তিনি 'বিজয়া-সম্মিলন' নামে প্রবন্ধটি পাঠ করেন। বঙ্গজীবনের সঙ্কটকালে একসূত্রে গ্রন্থিত হবার জন্য এই প্রবন্ধে কবি হিন্দুদের বিজয়া পালনের সঙ্গে 'অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে' তাকেও আহ্বান জানিয়েছিলেন । বক্তব্য পেশ করার পর সেই সভায় তিনি গেয়ে শুনিয়েছিলেন গান, 'বাংলার মাটি, বাংলার জল'; যা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলো 'রাখীসঙ্গীত' বিশেষণে। অতুলচন্দ্র গুপ্তের স্মৃতিচারণায় পাই, ‘এই দেশব্যাপী উন্মাদনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দূরত্ব ঘুচিয়ে আমাদের মধ্যে এলেন, হ'য়ে উঠলেন ছাত্রদের অন্তরঙ্গ। প্রথম রাখী-বন্ধনের দিন গান চাই। "বাংলার মাটি বাংলার জল" প্রস্তুত।‘ কবির ব্যক্তিত্বে আনন্দের কমতি দেখেনি কেউ। কিন্তু 'উচ্ছ্বাস' ? নৈব নৈব চ। ব্যতিক্রম হয়েছিলো ১৯০৫ সালে ষোলো'ই অক্টোবরে রাখীবন্ধনের মিছিলে। কবি পরে সজনীকান্ত দাসকে বলেছিলেন, ' যাকে সামনে পেতাম, তারই হাতে বাঁধতাম রাখি। সরকারি পুলিশ ও কনস্টেবলদেরও বাদ দিতাম না। মনে পড়ে, এক একবার একজন কনস্টেবল হাতজোড় করে বলেছিল, মাফ করবেন হুজুর, আমি মুসলমান।' অরুণকুমার বসু বলেছিলেন, ‘১২৯২ সালে ঢপকীর্তনের লৌকিক কাঠামোতেই কবি ' একবার তোরা মা বলিয়া ডাক ' গানটি রচনা করেন। এই একই সুরের কাঠামোয় এরও আগে তিনি ভানুসিংহের পদাবলীর সুপরিচিত ' গহন কুসুমকুঞ্জ মাঝে ' এবং পরবর্তীকালে স্মরণীয় রাখিসংগীত ' বাংলার মাটি বাংলার জল ' গান দুটি রচনা করেন। এর সঙ্গে বাউল সুরের কোনো সম্পর্ক নেই।‘ যদিও বাংলাভাগের প্রতিবাদে রাজনৈতিক রাখিবন্ধন, রাখিপূর্ণিমার দিনে পালিত হয়নি। কিন্তু আজ যখন আমাদের সমাজ আবার আরেক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হয়ে বিপন্ন, এই গানটির কোনও বিকল্প নেই। ছোটোবেলায় গাইতুম। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে গানটি গাইবার সময় যে আবেগ অনুভবে এলো, তা আগে ভাবিনি। আজ রাখিপূর্ণিমা। এই গানটিও থাকলো, বন্ধুরা যদি কেউ শোনেন, তবে যথারীতি ইয়ারফোন ব্যবহার করার অনুরোধ রইলো, https://www.youtube.com/watch?v=iwNgiiZOsDU
শিবাংশু
শ্রাবণ বর্ষার সেই দিন তিনি ভৈরবী সুরের উৎস খুঁজতে খুঁজতে চরাচরের অন্য পারে চলে গেলেন। ঠিক তার দু বছর আগে শুরু হয়েছিলো মানুষের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত তীব্রতম মারণযজ্ঞের আয়োজন। ১৯৩৯ সালের বর্ষাকাল বললেই সবার আগে মনে পড়ে যায় পয়লা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের সীমানায় হিটলারের ব্লিৎজক্রিগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। য়ুরোপে অশান্তির আগুন বেড়ে ওঠা নিয়ে বহুদিন ধরেই কবি চিন্তিত ছিলেন। তখন তাঁর আটাত্তর বছর বয়স। সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে মহাজাতি সদনের ভিত্তি স্থাপন করলেন। জওয়াহরলাল আর সুভাষচন্দ্র তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শান্তিনিকেতন এলেন। বন্ধু কবি ডাব্লিউ বি য়েটস গত সদ্যপ্রয়াত। ঘরে-বাইরে এমন একটা টালমাটাল সময়ে কবি রচনা করলেন এই গানটি। সুর দিলেন প্রিয় সুর ভৈরবীর সঙ্গে রামকেলির মিশেল দিয়ে। কাহারবা তাল, ধীর লয়ে বাঁধা। হিসেব মতো বর্ষা ঋতুর অনুষঙ্গ মাখা গানটি কিন্তু আসলে গভীর, অনুরণিত ভালোবাসার সীমাহীন উৎসস্রোত। যে ভালোবাসা, কবির দেখার চোখে একেবারে অন্যরকম, আলাদা। '... মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যে যে-একটি নিত্যশোক নিত্যভয় নিত্যমিনতির ভাব আছে, আমাদের হৃদয় উদ্ঘাটন করে ভৈরবী সেই কান্নাকাটি মুক্ত করে দেয়-- আমাদের বেদনার সঙ্গে জগদ্ব্যাপী বেদনার সম্পর্ক স্থাপন করে দেয়। সত্যিই তো আমাদের কিছুই স্থায়ী নয়, কিন্তু প্রকৃতি কী এক অদ্ভুত মন্ত্রবলে সেই কথাটিই আমাদের সর্বদা ভুলিয়ে রেখেছে-সেইজন্যেই আমরা উৎসাহের সহিত সংসারের কাজ করতে পারি। ভৈরবীতে সেই চিরসত্য সেই মৃত্যুবেদনা প্রকাশ হয়ে পড়ে ...' (সঙ্গীতের মুক্তি-রবীন্দ্রনাথ) বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ...বিশুদ্ধ আবেগের জগতে আমাদের পৌঁছে দেবার নানা রাস্তাই তিনি আবিষ্কার করেছেন, তার মধ্যে যে-পথ সব চেয়ে সরল ও ঋজু তা প্রকৃতি কিংবা ঋতুচক্র। ব্রহ্মসংগীত যেমন সব চাইতে অ-রাবীন্দ্রিক, তেমনি ঋতুর গানগুলো রাবীন্দ্রিক সৌরভে সব চেয়ে বেশি ভরপুর, সেখানে প্রতিটি কথার চরম ব্যঞ্জনা নিষ্কাশিত।' (রবীন্দ্রনাথের গান- বুদ্ধদেব বসু) আজ শ্রাবণের দিনে এই গান যেন কোনও এক দৈবী বায়োস্কোপের দৃশ্যগুলি পর পর সাজিয়ে দেয় আমাদের অবচেতনের পর্দায়। আমার কবির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা এই গান নিবেদন করলুম কবিকেই, ‘কিছু বলব বলে এসেছিলেম...’ এই বাইশে শ্রাবণে… যদি কেউ শোনেন, তবে ঐ ইয়ারফোনের অনুরোধটি বাঁধা থাকলো, https://www.youtube.com/watch?v=zQDe3-GEVWw
মনোজ ভট্টাচার্য
সপ্তাহখানেক হয়ে গেল এটা ঘটেছে – লিখে রেখেছিও ! কিন্তু আলস্যের কারনে এটা এখানে দেওয়া হয় নি ! – যদিও তারতম্য কিছুই হয় না ! শুধু আমার দিল-খুশ ! একটা বোন পেয়েছি - ফেশবুকে ! হ্যাঁ সত্যিকারের মানুষ বোন । কুম্ভমেলা বা সাগরে হারিয়ে যাওয়া বোন নয় ! এমন কি জন্মে ইস্তক আমি তাকে কখনো দেখিনি – সে-ও আমাকে কখনো দেখেনি ! - মনে হচ্ছে যেন বিগ বাকেটে গিয়ে র্যাক থেকে একটা বোন নামিয়ে নিয়ে আনলাম ! ঠিক তা নয় ! ফেস বুকে একটা লেখা বের হল – কেয়ার ওপর । - তার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে একজন লিখলেন – তিনি কেয়ার বোন ! অনেক ভাবনা চিন্তার পর আমি জিগ্যেসই করে ফেললাম – ওনার পরিচয় – মানে কি ধরনের বোন ! উনি সম্পর্কের যে পরিচয় দিলেন – সে প্রায় মায়ের ভায়ের ভাগ্নে জামাই – ইত্যাদি ! আমরা শহরের লোকেরা সাধারনত - এতদূর সম্পর্কের কাউকে নিজেদের ভাই-বোন বলি না ! তবু অনেকে আত্মিকতার খাতিরে বলে ‘আপন মামাতো বোনের ননদের আপন নাত-জামাই’ বটে ! এতে অন্যায়ের কিছু দেখি না ! মামাবাড়ির মামার বাড়ি ! বসুধৈব কুটুম্বকম ! তা ইনি কি কেয়াকে দেখেছেন ? – না – তবে শুনেছেন বাড়িতে – মামার বাড়ির গল্প! আর যাকিছু বর্ণনা দিলেন সবই আমাদের বাড়ির দিকে ট্রিগার ! এনাদের বাড়ি নিমতলা ঘাট স্ট্রিট ! বছর আস্টেক আগে চাবি করাতে – ঠিক ঐ বাড়ির উল্টোদিকেই যেতে হয়েছিল – তখন বাড়িটার সামনে গিয়ে দেখেছি প্রবেশ দ্বারের নামের প্লেটটা পর্যন্ত আছে । সে ঠিক আছে । আমার পরিচয় দিতে তিনি বললেন – তাহলে আপনি তো আমার দাদা হন ! – অগত্যা ! কি ভাগ্যি নিমতলা থেকে দৌড়ে এসে রাখী পড়াতে চায় নি ! ভার্চুয়ালই যে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করেছে – সেটা নিশ্চিত ! বলে বসি – শুধু দাদা নয় - একেবারে দাদু দাদা ! ওদের বাড়িটা বা পরিবারটা তৎকালীন বঙ্গসমাজের ইতিহাসে ঢুকে আছে চিকিৎসা বিদ্যার জন্যে । দেশবন্ধু পার্কের সামনের দিকে ওনার পিতামহ – সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের মর্মর মূর্তি রয়েছে ! ও রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের মারোয়াড়ী হাসপাতালেও ওনার প্রচুর দান-ধ্যান আছে ! উনি ডাক্তার আর জি কর এর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতেন ! - আমি একবার লিখেছি – হাঠখোলার দত্তবাড়ির সঙ্গে অনেক বাড়ির ভাব ভালবাসা ও বৈরিতা প্রসিদ্ধ ছিল । আমার দিদিমার ভাই সেই সময়ে কোন ব্যাপার নিয়ে মত-দ্বৈধতার ফলে - বন্দুক হাতে নিয়ে ঠাকুরমার ভায়ের নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের বাড়িতে হামলা করেছিল – আর শেষ পর্যন্ত একটা খুন পর্যন্ত ঘটেছিল ! এসব তো আমার শোনা কথা – কার গুলিতে কে মরেছিল – তা বলতে পারব না ! তবে তার কিছুদিন পরে – রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে হাতের সিগারেটের আগুনে ঘর বিছানা ও নিজে পুরে মারা গেছিল । কি ভাগ্যি – তিনি অবিবাহিত ছিলেন – তাই ইতিহাস হাওয়ায় উড়ে গেছে ! এ সব তখন বাবু-কালচারের অঙ্গ! আমরা এখনও বাতাসা কুড়নো ভক্তের মতো তাদের কথা বলে থাকি ! যাই হোক, কালের ফশিল থেকে বেড়িয়ে আসি ! কথা প্রসঙ্গে জানতে পারি - আমার বোন একটু আধটু সাহিত্য চর্চা করে । - আমি কি আপনাকে মাঝে মাঝে ফোন করতে পারি ? – কি বলবো ! নিশ্চয় ! - আমি যখন ওদের বাড়ির কিছু কিছু ঘটনা বলি – খুবই অবাক হয়ে যায় ! – এ তো কলকাতার ইতিহাস ! – তা বটে ! প্রোফাইলে ওর ছবি দেখে খুব ভালো লাগলো ! বেশ ভগিনি ভগিনি ভাব ! – নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের সবাই খুবই সুন্দর দেখতে । - আমাকে জিগ্যেস করলো – প্রোফাইলে আমার কোন ছবি নেই কেন ? কি আর বলি ! এই ছবি দেখলে যে কেউ লাইক পর্যন্ত দেবে না – সে কি আর আমি বলতে পারি ! বললাম – এমন প্যান্তা ফ্যাচাং ছবি দিলে সবাই ভির্মি খাবে – তাই দিই নি ! শুনে হাসি ! আপাতত এটাকে অসমাপ্ত রাখি – দেখি কবে আবার রাখী নিয়ে – সিঁথিতে ধাওয়া করে ! মনোজ
মনোজ ভট্টাচার্য
বৃদ্ধাবাসের একটি কোনে – আসলে কোথা থেকে যে আরম্ভ করি – সেটা ভাবতে ভাবতেই কত সময় বয়ে যায় ! এটা সত্যি ঘটনা হলেও আমি কিছু গোপন করেছি । - তাই ‘গল্প’ বলা চলে , কিন্তু ‘গুল্প’ নয় ! আমাকে বৃদ্ধাবাসের আবাসিকদের সঙ্গে আলাপ করাচ্ছিল – ওনার সেবিকা । একদম শেষ ঘরটায় তিনি বসে আছেন । ঠিক বসে আছেন বলা যায় না – হুইল চেয়ারে সমাসীন ! তিনি ল্যাপটপ খুলে ও কানে মোবাইলের ইয়ার ফোন গোঁজা – কিছু কাজ করছিলেন । আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললেন – আসুন আসুন ! খেয়াল করলাম – ওনার বাংলা বলা অভ্যেস নেই ! আমি ওনার কুশল জিগ্যেস করলাম ! তখনই উনি বললেন – উনি কলকাতায় জন্মেছেন, কিন্তু এক বর্ণ বাংলা বলতে পারেন না ! হিন্দিও জানেন না । এখানে এরা ইংরিজি কিছু বুঝতে পারে – সেটাই সুবিধে ! নাম ধরা যাক – দোশী – প্রথম নামটা লিখলে – গুগুলে সব পরিচয় আছে - সেটা আমি এড়িয়ে যাচ্ছি । - আমি জিগ্যেস করলাম – আপনি সেই ব্যক্তি কিনা ! – উত্তরে উনি না-ও বললেন না ! বুঝলাম কোন কারনে প্রকাশ করতে চান না ! দোশীজিরা আদতে গুজরাটি । ওনার পূর্বপুরুষরা গুজরাট থেকে বর্মায় চলে গেছিলেন। তারপর যখন বার্মা থেকে ভারতীয়রা ফিরে এল – ওনারা কলকাতায় স্থিত হলেন । উনি কলকাতাতেই জন্মেছেন । এখানে সেন্ট জেভিয়ারসে পড়াশুনা করেছিলেন । গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে কলকাতা থেকে চলে গেলেন ডালাসে । তারপর থেকে সেখানেই । অনেকবার ইউরোপে গেছেন কাজের ধান্ধায় । খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমেরিকার বিভিন্ন শহরে থেকেছেন ! – আমাকে নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা দেখে অনেক ক্ষণ আলাপ করলেন । নানান বিষয় । নিউ ইয়র্ক খুব লাইভলি জায়গা, ইত্যাদি ! ওনার কলকাতায় কেউ আছেন – না ! পুনেতে কেউ আছেন । দুই সৎ ভাই – যারা কেবল টাকা চায় ! ওদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেন নি ! বিয়ে হয়েছিলো এক অ্যামেরিকান মেয়ের সঙ্গে । তার জুভেনাইল ডায়াবিটিশ ছিল । দীর্ঘ দিন ডায়ালিসিস করার পর তিনি শেষ হয়ে যান ! একটা ছবি দেখালেন । ছবিটা কবেকার তোলা – কে জানে ! ছবিটা দেখে মনে হল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ! – তারপর থেকেই দুনিয়াতে তিনি একেবারে একা ! পরে শুনেছি – ডালাসে নাকি মাঝে মাঝে ফোন করেন ! ওখানে নিশ্চয় বন্ধু বান্ধব আছে ! গত বছর তার একবার স্ট্রোক হয় ! তারপর তিনি ভারতে ফেরেন – পুনেতে ! কিন্তু কলকাতাতে পায়ের একটা থেরাপি করতে এসেছেন । আমেরিকা থেকে প্রচুর ব্যবহার্য জিনিস এনেছেন । প্রচুর বই এবং অন্তত চারটে বুক র্যাকক ! সব কটা ভর্তি । সবই কিন্তু টেকনিকাল ! বেশি তাকিয়ে থাকলেও মনে হচ্ছে – বইগুলো থেকে ভারনিয়ার – মাইক্রোমিটার ইশারা করে ডাকছে ! আর একটা বেড – ইয়া পুরু গদী । - বাইরের বারান্ডায় বিরাট বিরাট সুটকেশ ! দুটো রিভল্ভিং চেয়ার ! কি আশ্চর্য ! ঠিক আমারই মত চিন্তাধারা ! কলকাতায় জন্মেছিলেন । চল্লিশ বছর প্রবাসে কাটিয়ে - এখন এই জীবনের শেষভাগে এসে সেই কলকাতাই হল আশ্রয় ! কেউ কোথাও নেই তো কি হয়েছে – আমার কলকাতা তো আছেই ! - - বৃদ্ধাবাসের একটি কোনে আছিল স্থান তব - বিশ্ব পরিক্রমা সাঙ্গ করি যবে আসিবি ফিরে - - ! মনোজ
মনোজ ভট্টাচার্য
থিয়ান আন মেন স্কোয়ার ! 天安门广场 থিয়ান আন মেন স্কোয়ার – মানে – আকাশে শান্তির দরজা অর্থাৎ স্বর্গদ্বার বা শান্তির দ্বার ! পরের দিন যখন বাস এসে থামল – থিয়ান আন মান স্কোয়ার এ – আমরা খুব অবাক ! এত বড় একটা বর্গাকৃতি মাঠ বেজিং শহরের মধ্যিখানে ! পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্কোয়ার – প্রায় ১০৯ একর জুড়ে । এর মধ্যে মিউজিয়াম আছে তিনটে – তার মধ্যে আছে বিপ্লবে মৃত মানুষের সৌধ । আর আছে মাও-ৎসে-তুঙ্গের একটা স্মৃতি সৌধ , ও তার মৃতদেহও সংরক্ষিত আছে ! চারিদিকে সারা পৃথিবী থেকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় গিজ গিজ করছে ! প্রত্যেক দলের হাতেই একটা করে ছোটো পতাকা । তাই দেখে নিজের নিজের গ্রুপের খোঁজ রাখে ! – সেখানে প্রত্যেক গ্রুপের ম্যানেজার নির্দিষ্ট করে দেয় তার সঠিক অবস্থান ! আর সময় নির্দিষ্ট করে দেয় । এই সময়ের মধ্যে ঠিক এখানেই ফিরে আসতে হবে ! – কিন্তু ঐ বিরাট যায়গায় সবাই ছবি তুলতে তুলতে দিশাহারা হয়ে যায় ! তিনদিকে বিরাট মিউজিয়াম তার ছবি নিতে নিতে সময় চলে যায় ! অথচ মাও ৎসে তুং এর সেই বিরাট বানী রয়েছে বিরাট রাস্তার অপর পাড়ে । সেখানে না গেলে ভালো ছবি আসবে কি ! মুস্কিল হচ্ছে সোজাসুজি রাস্তা টপকে যাওয়া যাবে না। প্রচন্ড গতিতে গাড়ি যাতায়াত করছে আট লেনের রাস্তা দিয়ে । – রাস্তার নীচ দিয়ে টানেল আছে । সেখান দিয়ে ওপারে যাওয়া যায় । কিন্তু কি ভিড় ! তাড়াতাড়ি চলে – কার সাধ্যি ! – আমি তো টানেল দিয়ে সোজা বেরিয়ে এসে - মাও ৎসে তুঙ্গের সামনে ! – বেশ কিছু পাহারাদার দাঁড়িয়ে আছে – যারা মানুষ কিনা বোঝা মুস্কিল ! মনে হয় মোমের পুতুল – ডামি হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে ! – এদের চোখে ক্যামেরা বসানো আছে ! – কিন্তু তা নয় । খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বোঝা যাবে – প্রত্যেকে জীবন্ত পাহারাদার । সমস্ত নজরে আছে ! – লাইনে যেতে যেতেও দুধারে থেকে থেকে পাহারাদার দাঁড়িয়ে । এমনিতে সোজা দৃষ্টি । কিন্তু আমার সামনে কয়েকটা সাদা চামড়ার ছেলে-মেয়ে যাচ্ছিল – ওদের চোখের মণি থেকে পুরো মুন্ডু ঘুরে গেল ! ঘরপোড়া মানুষ – মাঠে সাদা চামড়া দেখলেই সতর্ক হয়ে যায় ! তখন আমি একা থিয়ান আন মেন স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ের মাঝে – হারিয়ে গেলাম ! সত্যিই হারিয়ে গেলাম ! প্রায় এক ঘণ্টা ধরে খোঁজাখুঁজির পর এবং দুবার পুলিশের হাত থেকে ধরা পড়ে ও ছাড়া পেয়ে – একটি অল্প ইংরিজি জানা ছেলে আমাকে সাহায্য করলো । তার ফোন থেকে আমাদের টীমের চীনাভাষী গাইডের মাধ্যমে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে যখন পৌঁছলাম – তখনও কেউ এসে পৌঁছয় নি । হারিয়ে যাবার সাত ঘণ্টা পরে – ওদের বাস এলো আমায় তুলে নিয়ে যেতে ! এত জ্যাম বেজিংএ ! বেজিংএর জ্যাম নাকি বিখ্যাত ! সেই রাতে রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসতে রাত বারোটা বেজে গেল! থিয়ান আন মেন স্কোয়ারের পেছনেই – নিষিদ্ধ নগরী । – মিং ডায়নেস্টি থেকে ছিং ডায়নেস্টি পর্যন্ত শাসকদের বাসস্থান ছিল এই প্রাসাদে । প্রাসাদের ভেতর আগে কারুর ঢোকার অনুমতি ছিল না । এখন অবশ্য কোনও বাধা নিষেধ নেই । - এখন লোকে এই প্রাসাদকে পুরনো প্রাসাদ বলে। এখানে প্রাচীন অনেক স্থাপত্যের কাজ রাখা আছে । একটা কথা এখানে না লিখলেই নয় । - গুগুলের সৎ প্রচেষ্টা ! থিয়ান আন মেন স্কোয়ারে ফরবিডেন সিটি গেটের ওপরে বিরাট দুটো শ্লোগান লেখা আছে ! চুং হুয়া রেন মিন গুং হ কো - - এবং ইয়ে শিয়া রেন মিন রেন তা - - ! এই দুটো ফ্রেজ এর মানে খোঁজার জন্যে যতগুলো সাইট আছে – দেখেছি। সব নিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে । কিছুতেই মানেটা দিচ্ছে না ! প্রথম লাইনটার মানে যতদূর মনে পড়ে চীনা গনতন্ত্রের মানুষদের বিপ্লব জিন্দাবাদ ! দ্বিতীয় লাইনটার মানে – মহান এশিয়ার মানুষদের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক ! খুব অবাক লাগছে – কেন এই লাইন দুটো ওদের এত শিরঃপীড়া ! – অবশ্য গুগুলের এই অপচেষ্টা আগেও দেখেছি – আন্দামানের ক্ষেত্রে ! সামার প্যালেস – বা গ্রীস্মাবাস – এখানে বিরাট একটা লেক আছে । এই লেক ঘিরে কয়েকটা প্রাসাদ আছে । নৌকা করে সেখানে যেতে হয় । গ্রীস্মকালে শাসকরা এখানে থাকত । শোনা যায়– সম্রাট ও তার স্ত্রী যখন কোন প্রাসাদে থাকত – তখন সবাই জানতো – ওনারা থাকতেন অন্য প্রাসাদে ! – এখানে স্থাপত্য ছাড়া – লেক ও ছোটো দুটো পাহাড় ঘেরা দৃশ্য খুব আকর্ষণীয় ! – প্যাকেজ ট্যুর কভার করতে এখানে আনা হয় ! বেশ কয়েকটা বুদ্ধ মন্দিরে যেতে হয়েছে ! বেজিঙ্গের একটা বৌদ্ধ মন্দিরে গেছি । দেখলাম সবাই গোছা গোছা ধূপ কিনে জ্বালিয়ে মন্দিরের সামনে আরতি দেওয়ার মতো করছে ! মন্দিরের ভেতর নয় কিন্তু । ভেতরে তো পর্যটকরা ঘুরে ঘুরে দেখছে । মোটামুটি সব মন্দিরেই এই ধরনের ব্যাপার স্যাপার ! সবাই শাক্যমুনি গৌতমের ও কিছু শয়তানের অস্তিত্ব ও কিছু উপকাহিনীর জন্ম দিয়েছে ! – প্রনামী, দক্ষিণা, পাণ্ডা, ইত্যাদির কোনও ব্যাপারই নেই ! – তবে স্টলে কিছু কিছু মালা ও আরও কিছু শ্যুভেনিয়ার বিক্রি হচ্ছে ! আজ এখানে বিশ্রাম – ক্রমশ আমরা চীনের প্রাচীরে আসছি ।
মনোজ ভট্টাচার্য
মুক্তি কোথায় আছে ! এক দেশে চারজন যুবক ছিল । রাজার ছেলে, মন্ত্রীর ছেলে, কোষাধ্যক্ষের ছেলে ও সেনাপতির ছেলে ! তাদের রাজ্যের প্রতি কোন দায়-দায়িত্ব ছিল না ! শুধু ঘুরে ঘুরে অপাট কুপাট করে বেড়াত ও বর্ধিষ্ণু নাগরিকদের উত্যক্ত করত ! সবাই রাজার কাছে নালিশ করত । কিন্তু বিশেষ কোন পরিবর্তন হতো না ! তিতি-বিরক্ত হয়ে রাজা মন্ত্রী কোটাল ও কোষাধ্যক্ষ মিলে ঠিক করলো – ছেলেদের শিক্ষা দিতে হবে ! কি করে ! প্রত্যেকেই বাড়ি ফিরে ছেলেদের মায়েদের বলল – ছেলেদের ভাত না দিয়ে ছাই দিতে ! সে কি আর মায়েরা পারে ! কিন্তু স্বামীদের আদেশ ! পাথরে বুক বেঁধে ছেলেদের থালার পাশে একটু ছাই রেখে দিল । রাজপুত্র খেতে বসেই দেখতে পেল – থালার পাশে ছাই আছে ! ব্যস ! খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লো । চার বন্ধু একসঙ্গে মিলে ঠিক করলো – আর এখানে নয় ! এবার নিজেদের অন্ন নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে ! – ওরা বেড়িয়ে পড়লো অজানার সন্ধানে ! ঠিক হল – যার যেখানে খুসি থেকে যেতে পারে ! যেতে যেতে যেতে যেতে – ওরা দেখতে পেল – লোহার খনি । - কেউ বিশেষ পাত্তা না দিলেও কোটাল-পুত্র ভাবল – কোথায় যাবো কি পাবো – কোন ঠিক নেই ! এখানেই থেকে যাই ! যা লোহা পাই – তাই দিয়েই আমার চলে যাবে ! অতয়েব কোটাল-পুত্রকে লোহাপুরে রেখে বাকি তিনজনে আবার চলতে আরম্ভ করলো ! খানিক দূরে গিয়ে ওরা এবার রূপোর খনি দেখতে পেল ! সেখানে কোষাধ্যক্ষের ছেলে রূপোর কথা ভেবে থেকে যেতে চাইল ! বেনের-পো রূপ-নগরেই থেকে গেল ! এইভাবে বাকি দুজন চলতে চলতে খানিক দূরে গিয়ে একটা সোনার খনি দেখতে পেল । মন্ত্রী-পুত্র বলল – রাজপুত্র, আর যাবার প্রয়োজন নেই । এইখানেই থামা যাক ! এখানে যা সোনা পাওয়া যাবে – তাতে আমাদের রাজত্বের মতো থাকা যাবে ! রাজপুত্রের তো উচ্চাশা ! সে বলল – দেখি না আরও গিয়ে । কি আছে এর পর ! তাই একাই চলতে লাগলো । অনেকক্ষণ যাবার পর হঠাৎ শুনতে পেল – কেউ বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে ! সে তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে দেখতে পেল – একজন দুহাত তুলে প্রানপনে চেঁচাচ্ছে – আর তার মাথার ওপর বিরাট একটা লাট্টুর মতো চাকা ঘুরছে – মাথার থেকে রক্ত চারদিক ছরাচ্ছে । রাজপুত্র তাড়াতাড়ি সেখানে যেতেই – সেই বিরাট লাট্টু উড়ে এসে তারই মাথার ওপর ঘুরতে লাগলো । আর মাথার থেকে রক্ত ছিটকে পড়তে লাগলো ! পূর্বের সেই লোক ওকে বলল – ধন্যবাদ তোমাকে ! আমি অনেক দিন ধরে এটা বয়েছি । আমার ওপর নির্দেশ ছিল – অনেকদিন পর তোমার মতো কেউ এসে আমার এই বোঝা নেবে ! এতদিন পর তুমি এসে আমাকে মুক্তি দিলে ! – চলি ! রাজপুত্র সমানে চেষ্টা করছিল – সেই লাট্টুটা ফেলে দেবার । কিন্তু সে পারছিল না । আগের লোকটি চলে যাচ্ছে দেখে – সে মরিয়া হয়ে জিগ্যেস করলো – যাবার আগে শুধু বলে যাও কতদিন ধরে তুমি এই কষ্ট পাচ্ছিলে ? সে চেঁচিয়ে উত্তর দিল – আমি এই ভার পেয়েছি স্বয়ং বুদ্ধদেবের কাছ থেকে ! তোমাকেও কেউ না কেউ একদিন এসে মুক্তি দেবে ! অমর চিত্র কথার এই গল্পটা অল্প-বিস্তর সবাই জানেন ! সেই থেকে মনোজবাবু – কোন একজনকে খুজেই চলেছে – যে কিনা এই দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেবে ! পেলও একজনকে । কল্যান ! বয়েসে তরুন বলা চলে – সবে অবসর পেয়েছে কর্মজীবন থেকে ! দারুন উৎসাহী ! রাজি হল । তখন কি আর কেউ জানত – করোনা রোগে কল্যাণকে একেবারে অবসর পাইয়ে দেবে !
শিবাংশু
বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, "....গান তাঁর সব চেয়ে বড়ো, সব চেয়ে ব্যক্তিগত ও বিশিষ্ট সৃষ্টি; সমগ্র রবীন্দ্র-রচনাবলীর মধ্যে গানগুলি সব চেয়ে রাবীন্দ্রিক। " তাঁর বয়স যখন মাত্র আঠাশ বছর, তখন তিনি লেখেন, মানে লিখতে পারেন, 'মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর'। তখনও তিনি ব্যক্তিজীবনের অনন্তপ্লাবী শোক, অনিরুদ্ধ বহমান মৃত্যুর মিছিলের স্পর্শ পুরোপুরি পাননি। মৃত্যুকে টিকে থাকার জন্য জীবনের কাছেই করজোড়ে এসে দাঁড়াতে হবে, এই বোধ অর্জন করতে কতো উপনিষদের ঋষি জন্মজন্মান্তর কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি যৌবনের মদির প্রহরে সেই বোধকে আত্মস্থ করেছিলেন অবলীলায়। সেজন্যই মানুষ তাঁকে আদিকবি, কবিগুরু নাম দিয়ে মেপে দেখতে চায়। তখন ছিলেন শোলাপুরে সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে। 'রাজা ও রানি' নাটক সেখানেই বসে লেখা। গানটি ঐ নাটকেরই অংশ। কলকাতায় ফিরে বির্জি তালাওয়ের বাড়িতে মঞ্চস্থ হয়েছিলো প্রথম। সন ১৮৮৯। অভিনয়ে ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী, মৃণালিনী। চারদিকে অক্ষম বাঙালিদের ছিছিক্কার। এই ছিলো তাঁর 'বাঁধন ছেঁড়ার সাধন'। সুর দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় সুর পিলু-বারোঁয়ায়। তাল, মুক্ত বা টপ্পাঙ্গ। চিরকাল মনে হয়েছে এই গান সেই সব মানুষদের জন্য, যাঁরা বাহিরের বাঁশির ডাকে ঘরছাড়া, কিন্তু পরকে আপন করতে দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যান। আমাদের সভ্যতার মশালবাহক সেই সব মানুষ। আজ বাঙালির নতুন বছরের প্রথম দিনে তাঁদের স্মরণ করে অধমের নিবেদন। বন্ধুদের জন্য, https://www.youtube.com/watch?v=ybOk-cecUmM
Stuti Biswas
আজকের যুগে চিঠি লুপ্তপ্রায় বস্তুর মধ্যে পরে । এই গতির যুগে পাতার পর পাতা চিঠি পড়ার সময় কার আছে ? এক লাইনের মেসেজ ছুড়ে দিয়েই কাজ সারা । কিন্তু আমার এখনও চিঠি পড়তে ভীষন ভাল লাগে । হঠাতই আমার হাতে এসেছে এক বর্মি বাক্স । খুলেই দেখি মলিন হয়ে যাওয়া নীল কাগজের কিছু চিঠি । আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ পূর্বে কোন এক নিরীহ , সদাশিব , শিক্ষিত , গরীব যুবক বিবাহসূত্রে বাঁধা পরেছিলেন আদরের দুলালী কোন এক জমিদার কন্যার সাথে। কন্যাটি ছিলেন দানবীর , সত্যবাদী কিন্তু একটু জেদী প্রকৃতির । মেয়েটির পিতা মাঝে মাঝেই কন্যাকে পিত্রালয়ে নিয়ে যেতেন । বাড়ীতে স্ত্রী বিনা স্বামীটির বেহাল অবস্থা । ঐ যুগে সে কথা প্রকাশ করার কোন সুযোগ ছিল না । ভারাক্রান্ত মনের ভাব প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। সেরকমই একটি চিঠি । ---------------------------------------------------------------- প্রিয়তমাসু আজ কদিন থেকেই বেশ চলেছে উদাস মনের একটা আবছায়া দ্বন্দ ; যেমন চলেছিল একদিন হ্যামলেটের মনে - পড়েছ হ্যামলেটের গল্প ? মা তার বাইরের এক পুরুষের সঙ্গে মিথ্যা অবৈধ প্রেমাকৃষ্ট হয়ে হত্যা করেছিল তার স্বামীকে বিষ প্রয়োগে - একথা যেদিন জানতে পারল হ্যামলেট - সেদিন থেকে তার জীবনে এল ধিক্কার ; যে গর্ভ হতে সে ভুমিষ্ট তার পবিত্রতা নেই - পঙ্কিলময় ,কলঙ্কিত তাহা । মায়ের কলঙ্কের জন্য ,পিতার হত্যার জন্য সে আত্মহত্যা করতে গেল , -কিন্তু তখন মনে এল দ্বন্দ - " To die or not to die ........" অর্থাৎ " মরি কি না মরি ............" একদিকে ফল পুস্প গন্ধে ভরা এই সুন্দর পৃথিবী যার প্রতিটি অনু পরমাণুতে রয়েছে রুপ রস গন্ধ - তার মধ্যে একটি জীবনের বিকাশ আর একদিকে মৃত্যু যা অতি সত্য , অতি ধ্রূব অথচ কি বিভীষিকা। যে শুধু অশ্রূভরা পাড় , যাহা জ্ঞানের অতীত তীরে একটা আঁধার ।কোনটা নেবে হ্যামলেট - এই হাসিভরা পৃথিবী না ঐ অশ্রূভরা মৃত্যু ? এই ছিল দ্বন্দ ।তারপর ?তারপর আছে । লেখা বাহুল্য এরকম একটা দ্বন্দ আমার দুর্বল মনকে আজ কদিন থেকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে । কোনটা চাই ? " হৃদি দিয়ে হৃদি অনুভব করা " মিলন ? না উদাস বিরহ ? হৃদয়ের প্রতিটি অনু যাহাকে কেন্দ্র করে চলেছে - দেহের প্রতিটি অঙ্গ যাহাকে দুই বাহু তুলে ডাকছে - সে যদি পিছন ফিরে একবার না তাকায় - যদি সে তাহার কুমারী জীবনের শিবপূজার ব্যর্থতা প্রতিটি কথায় জানিয়ে দেয় , তার জীবনের কোন এক আকস্মিক বিপর্যয়ে তার সমাজ দেয় একটা মিথ্যা ঠাকুরকে প্রেমের ঠাকুর বলে মানতে যদি তার হৃদয় না চায় , তাহলে ?.....................তাহলে আমায় নিরুপায় হয়ে নিতে হবে বিরহ ।জীবনের কোন এক স্মরনীয় রাতের স্মৃতি নিয়ে চলতে হবে বাকী কটা দিন কিম্বা যেতে হবে এমন দেশে যেখানে অতীত নেই , স্মৃতি নেই , পশ্চাৎ নেই , যেখানে সব ভুলে যাওয়া যেতে পারে । যেখানে আছে কেবল ভবিষ্যৎ ।আছে এমন দেশ ? আছে । তাই বেঁধেছে দ্বন্দ । লিখছি আর ভাবছি কি হবে লিখে ; যার জন্য কোনই আগ্রহ নেই , যাহা পাওয়া মাত্রই আসবে গ্রহীতার বিতৃষ্ণা , বিরক্তি , যাহার পরিণতি হবে বিছানার নীচে , হয়তো কোন এক অবসর সময়ে নেহাত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পড়া হবে । সে চিঠি লেখার সার্থকতা কি? জানিয়েছিলে একদিন একটা অনুরোধ - তাই লিখতে বসেছি । হয়তো তোমার বন্ধুদের দেখাবে - " দেখ এই লোকটার পাগলামি , যত খেদাই ততই লেগে থাকে কাঁঠালের আঠার মত ।" খুব সত্য কথা ; কিন্তু একদিন তো তারও শেষ আছে । জীবনটাই যদি সব ভুল হয়ে যায় তবু তো সে ভুলের একদিন শেষ আছে ।যমুনার তীরে একদিন একটা বাঁশির সুর ছিল ভুল কিন্তু তারও শেষ হলো সত্যের পরিণতিতে ।ভুলেতেই যে জীবনের মাধুর্য্য তাই ভুল করি ............। আজ একেলা ঘরে পড়ার ছলে বসে কত আকাশ পাতাল ভাবি । সামনে থাকে lograthim বই আর গাদা করা Lesson কিন্তু মন যে উড়ে বেড়ায় , কোন একটা ব্যাথা অহরহ বেজে ওঠে বুকে - যেন মনে হয় কিছুই পেলাম না জীবনে । অর্থ ? তাকে তো নিবিড় করে কোন দিনই চাই নি ; - বিদ্যা ? কতকটা চেয়েছিলাম - সম্পূর্ণ পাই নি ;- আয় ? না থাক । আমিও যে চাওয়ার প্রকৃত রুপ দিতে পারিনি তাকে বাস্তবে তো পাওয়া সোজা নয় । তাই চেয়েছি কিন্তু পাই নি । খাপছারা কথা , অর্থহীন পাগলের উক্তি । সত্যি তাই । ঘুমের ঘোরে চারিদিকের স্তব্ধ অন্ধকার নিবিড় করে ঘিরে চুপিচুপি কানে কানে কয়ে যায় - তোমার অতীত নেই , যে অতীতের স্মৃতি কেবল অপমানে ভরা তা মিথ্যা , তাকে ছেড়ে দাও । চলে এসো ঐ সুদূর ভবিষ্যতের ইশারার ডাকে । কিন্তু প্রভাতের মৃদু আন্দোলনে যেন সব হারানো আবার ফিরে পাই , আছে আছে আমার সব আছে । অতীত আছে , বর্তমান আছে , ভবিষ্যৎ থাকবে । " নাহি ভয় হবে জয় " । সীমাহীন অচিন্তনীয় মহাকালের বুকে আমার ভালবাসার স্মৃতি কি এতটুকু স্থান পাবে না ? নিশ্চয়ই পাবে । তবে দুঃখ কিসের ? এত বাজে কথা তোমার নিশ্চয়ই ভাল লাগছে না । কাজের লোক না হয়ে বাজে লোক বলেই বাজে কথা লিখি । এ যে স্বভাব । আজ হতে এক বছর আগের কথা মনে হয় । সেই একবছর আগের আমার কাজ দিয়ে তোমাকে আমায় বিচার করতে বলি আর সেই সঙ্গে অনুরোধ একটু - কোন এক নিশ্চিন্ত ক্ষনে তোমার মনকে জিজ্ঞেস করো তার মধ্যে আমার স্থান আছে কিনা । দেখ , যেখানে অনুরাগ নেই সেখানে কর্তব্য থাকিলেও সেটা শুষ্ক হয়ে যায় আর সহজে ধরাও পরে । সবটা না বুঝলেও কিছুটা বুঝি । কিন্তু জানি অনেক কিছুই । যাক এনিয়ে বিশেষ লেখা বাহুল্য । টুন্টুনের অসুখ শুনলাম । ব্রঙ্কাইটিস হয়েছে তাও শুনলাম । তার অসুখ নাকি আমার মতো হতভাগা বাপের দ্বারাই হয়েছে কারণ তাকে কোন একদিন ঘুমন্ত অবস্থায় আমি নাকি ঠাণ্ডায় নিয়ে বেড়িয়েছিলাম । মনে পরে না , যদি করে থাকি হতভাগা বাপের মতই কাজ হয়েছে ।কেমন থাকে জানালে সুখী হতাম । একটু তাকে সাবধানে রাখিলে ভাল হয় ।এ বিষয়ে আমার কথার চাইতে তোমাদের দায়িত্বই বেশী । তোমার শরীর কেমন আছে জানাবে । আমার সম্বন্ধে তোমার কোন আগ্রহ আছে কি ? যাই হোক আমরা হলাম ছ্যাকড়া গাড়ীর ঘোড়া , মরতে মরতে ও বাঁচি আবার বাঁচতে বাঁচতে ও মরি । মা র শরীর আর নারু ভায়া কেমন পরীক্ষা দিচ্ছে জানতে পারি কি ? আমাদের কোনরকমে চলছে । হরিদাসী পর না হয়ে নিজের বোন হলে ভাগ্যবান মনে করতাম । ভালবাসা নিও । টুনটুনকে আমার স্নেহাশীষ জানাবে । ইতি তোমার স্বামী
মনোজ ভট্টাচার্য
বিধবা মায়ের বিয়ে ! একটা বিজ্ঞাপন দেখি টি ভি তে । এক মধ্যবয়স্কা মহিলা রেস্টুরেন্টে বসে আছে । একে একে তার ছেলে-বউমা, মেয়ে-জামাই সবাই আসছে । ওদিকে প্রবেশের কাছে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ঢুকে এলো । সবাই অবাক জিজ্ঞাসায় তাকিয়ে – মহিলা তার হাতের আংটি সবাইকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল – সেই লোকটি তার ছেলে-বন্ধু ! হয়ত তাকে বিয়ে করবে ! অথবা শয্যা-সাথী হবে ! সবাইর মুখের হাসি দেখে বোঝা গেল এই সম্পর্কে - সবাইরই সম্মতি আছে । - এটা দু হাজার সালের কথা ! এখন কত সহজ ! - আমার মনে পড়ে গেল ১৯৮০ সালের এক ঘটনা । আমার এক পিসির কথা । তারা খুবই ধনী ছিল । পিসির বিয়ে হয়েছিলো – যার সঙ্গে – সে একটা কাগজ-কারখানার মালিক ছিল । আরও তিন ভাইকে নিয়ে সংসার । ক্রমে তাদেরও বিয়ে হয়ে যায় । পিসির নিজেরও তিন ছেলে ও এক মেয়ে ! – সংসারে যদিও কোন অসদ্ভাব বা গণ্ডগোল ছিল না – কিন্তু পরের দুভাই কলকাতার অন্য যায়গায় বাড়ি ভাড়া করে থাকত । আসা যাওয়া – ঠিক-ঠাকই ছিল ! ক্রমশ ছেলে-মেয়েরাও বড় হয়ে উঠেছে – কলেজে পড়ে ! - কারখানায় প্রায় কুড়ি পঁচিশ জন কাজ করত । - সবই বেশ সুখকর পরিবেশ । একটা বেশ জমিদার বাড়ি – হই-চই মার্কা বিরাট সংসার ! একদিন বারাসাতের কারখানা থেকে গাড়িতে আসার সময়ে – একটা লড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে পিসেমশাই, গাড়ির চালক দুজনেই মারা গেল – হাসপাতালে । - হাসপাতাল, পুলিশ কেস, এনকোয়ারি, ইন্সিওরেন্স – হাজার ঝামেলা চলতে চলতে – দেখা গেল – দেওররা ক্রমে দূরে সরে গেছে । এমন কি তাদের দেখাদেখি - ছেলেরা পর্যন্ত সম্পত্তির ব্যাপার নিয়ে মায়ের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে কাকাদের সঙ্গে ! তাদের টাকার বড়ই দরকার । কারখানার দায়িত্ব আর কেউ নিল না । কারখানা বন্ধ হল । সেই বাড়িটাও ছেড়ে দিতে হল । পিসি একটা ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে সল্ট লেকে একাই থাকতে লাগলো ! একমাত্র মেয়ে জামাই সম্পর্ক রাখত । খোঁজ খবর নিত । আরও একজন খোঁজ খবর রাখত । গুনেনকাকা - ওদের এক পারিবারিক বন্ধু – কবে থেকে বা কার তরফে পরিবারে ভিড়েছিল – তা আর কারুর মনে নেই । পিশেমশাই বেঁচে থাকতে – এখান থেকেই তার বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো । কাছাকাছি আলাদা ফ্ল্যাটে থাকত । বছর কয়েকের মধ্যে কি করে জানি তার বৌ মারা গেছিলো । - তারপর থেকে পিসিদের বাড়িতে আসাযাওয়া খুব ঘন ঘনই ছিল । গুনেন কাকা - পিশেমশাই মারা যাওয়ার পর থেকে পিশির খুব বন্ধু হয়ে গেছিলো । বিশেষ করে পিসির সেই দুর্যোগের সময় সমানে পিসির সঙ্গে ঘোরাঘুরি, কোর্ট-কাছারি ইত্যাদি সমস্ত ঝামেলা সামলাতে হয়েছে – বন্ধু হিসেবে । ছেলেদের বিয়ে দিয়ে বৌ আনার ব্যাপারেও এই গুনেনকাকা ছিল – কিন্তু সেই বউরাই তার অস্তিত্ব নিয়ে ইঙ্গিত করতে আরম্ভ করলো ! - তারপর সম্পত্তি নিয়ে গণ্ডগোলের সময়ে এই গুনেনকাকাকে নিয়ে অশান্তি চরমে উঠল । পিসির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি উঠল ! ছেলেরাই প্রকাশ্যে গুনেন কাকাকে নানারকম অপমানসূচক কথা বলতে লাগলো ! পিসি খুব দৃঢ়চেতা – গুনেনকাকার বাড়িতে আসা বন্ধ করতে দিল না ! ফলে দেওরদের সাথে তো আগেই সম্পর্ক গেছিলো – এবার ছেলেদের সঙ্গেও সম্পর্ক কেটে গেল ! পিসেমশাই মারা যাওয়ার পর ঝামেলার মধ্যে দিয়ে সাত আট বছর কেটে গেছে । পিসি তার ফ্ল্যাটে একাই থাকে । একমাত্র মেয়ে ও জামাই তার খবরাখবর নেয় । এমনিতে পিসি খুব শক্ত মনের মানুষ ছিল ! কিন্তু অনেকদিন ধরে সংসার সম্পত্তি নিয়ে লড়াই করতে করতে পিসি ভেতরে ভেতরে বেশ একাই হয়ে গেল ! – এই সময় নাগাদ পিসি ও গুনেনকাকা পরস্পরের আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করলো – দুজনে একসঙ্গে থাকবে ! আগে থেকে একটা মাঝারি গোছের রেস্টুরেন্টে ছেলে-বউ ও তাদের বাচ্চাদের ডাকল । দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত হয়েছিলো । - সবাইর সামনে পিসি – গুনেনকাকার হাত ধরে বলল – আমি গুনিকে বিয়ে করছি ! এখনকার বিজ্ঞাপনের ছেলেরা বউরা যেমন সমর্থনের হাসি হাসল – সেদিনকার সেই ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম ছিল না ! বরং বেশ গরম তর্কাতর্কি ও ছেলেদের বৌ নিয়ে প্রস্থান হয়েছিলো । সবাই মায়ের দিকে আর গুনেনকাকার দিকে একেবারে ঘৃণাভরে তাকিয়ে শাসিয়ে গেল । আর যাবার সময় বা তার পরে কি মন্তব্য করেছিল – আন্দাজ করা যায় ! – কিন্তু পিসি আর গুনেনকাকা রেজিস্ট্রি অফিশে গিয়ে বিয়েই করেছিল ! সালটা ছিল ইংরিজি ১৯৮৮ ! এটা গল্প হিসেবে রাখাই ভালো ! মনোজ
শিবাংশু
রাম বসু কতোটা এলেমদার ছিলেন, সেটা বুঝতে একটু সময় লেগেছে। নিধুবাবুর সৌর জগতের অন্য প্রধান গ্রহগুলির এক জন রাম বসু। তাঁর গান গাইতুম, কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠা বিষয়ে বিশেষ কিছু জানতুম না। তাঁর কথা প্রথম পড়ি রাজনারায়ণ বসু মশায়ের 'সে কাল আর এ কাল' গ্রন্থে। " হরু ঠাকুর, নিতে বৈষ্ণব, রাসু নরসিং, রাম বসু, ভবানী বেণে, ইঁহাদিগের কবিতা সর্ব্বত্র বড় আমোদের বস্তু ছিলো।" ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মশায় এঁদের কবিতা সংগ্রহ করে সংবাদপ্রভাকরে প্রকাশ করতেন। ঈশ্বর গুপ্ত মশায় পক্ষপাতী ছিলেন নিতে বৈষ্ণব (নিতাইদাস বৈষ্ণব) কবিয়ালের। কিন্তু রাজনারায়ণের আনুগত্য ছিলো হরু ঠাকুর আর রাম বসুর প্রতি। তিনি হরু ঠাকুরের কবিতাকে প্লেটো এবং কোলরিজের সমকক্ষ মনে করতেন। আর অভিভূত থাকতেন রাম বসুর কবিত্ব শক্তির প্রতি। তিনি লিখেছিলেন " এই সকল কবিওয়ালারা তখনকার বিশেষ প্রতিপন্ন ব্যক্তি ছিলেন।" রাম বসু জন্মেছিলেন হাওড়ার শালিখায় (সালকে) ১৭৮৬ সালে। পুরো নাম রামমোহন, বাবার নাম রামলোচন বসু। স্বভাবকবি ছিলেন ছোটোবেলা থেকেই। ইংরিজি শিক্ষা নিয়ে সরকারি কাজও করতেনকিন্তু গানের নেশায় সেসব ত্যাগ করেন। রাগ মিশ্র ললিতে বাঁধা তাঁর এই বাংলা টপ্পাটি বিলম্বিত মধ্যদ্রুত একতালে শুনলে বোঝা যাবে বাংলা টপ্পার সঙ্গে পঞ্জাবি টপ্পার তফাৎটা কোথায়? এর মেজাজ খ্যয়ালের আলাপের সঙ্গে মেলে। যাকে বলা হয় টপ-খ্যয়াল। যথারীতি এ গান গাওয়ার অধিকার আমার আছে কি না, সেটা সংশয়ের উর্দ্ধে নয়। তবু বন্ধুদের উৎসাহে গেয়ে ফেলি। গুস্তাখি মাফ (শোনার ইচ্ছে হলে ইয়ারফোন ইত্যাদির অনুরোধ রইলো) https://www.youtube.com/watch?v=glyUG3Vhwys&fbclid=IwAR3ygNMEYEnCcW5Sm66DfAwBR28aj9P2yVjMCUCrkAB3m__Xj143kSUomhI
Stuti Biswas
আমাদের ছাত্রাবস্থায় স্কুলের সেশন শুরু হত জানুয়ারী মাসে । মে মাসে গরমের ছুটি । নামে ছুটি হলেও গরমের ছুটি বেশ অশান্তিতে কাটত । একদিকে প্রচণ্ড গরমে ঝালাপালা অবস্থা অন্যদিকে টেনশন - স্কুল খুললেই হাফ- ইয়ার্লি পরীক্ষা । ছুটির শুরুতেই মা রুটিন বানিয়ে দিত । রুটিনে থাকত দুপুরে অঙ্ক কষা । দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর অঙ্কের বইখাতা নিয়ে বসতাম বিছানায় । পাশেই মা গল্পের বই নিয়ে শুত । মার হাত থেকে গল্পের বই যখন ঢলে পড়ত মা বলত - ঠিক দুপুর বেলা ভুতে মারে ঢেলা ।একদম বিছানা ছেড়ে নামবি না । খানিক পরেই মা ঘুমের দেশে । এদিকে আমিও বিরক্ত অঙ্কের গোলকধাঁধায়। অনেক কষ্টে যদিবা একটা সমাধান করতে পারতাম , উত্তরমালা সব আশায় জল ঢেলে দিত । ঢেলা খাবার ভয়ে বইখাতা ছেড়ে উঠতে ভয় করত । এই সব বিপদ থেকে মাঝে মাঝে আমায় উদ্ধার করত ভুতই। কানেকানে বলত -লেখাপড়া করে যে গাড়ী চাপা পড়ে সে । গাড়ী চাপা পড়ার ভয়ে শিহরিত হয়ে আমি তাড়াতাড়ি খাতা পেন ফেলে উঠে পড়তাম । ভাড়ার ঘরের আচারের বয়ামদের মাধ্যাকর্ষণে খাবার টেবিলের চেয়ার টেনে তাকে উঠতাম । সার সার বয়াম । তেঁতুলের আচার , মিষ্টি আমের মোরব্বা , কুলের টক ঝাল , আমতেল । খামচা দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে সোজা ছাদে । আলসের নীচে লুকিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেতাম । আহা কি স্বাদ কোথায় লাগে খটখটে অঙ্ক । ছোটবেলা কেটেছে মফস্বল শহরে । মফঃস্বল হলেও এককালে ডেনিস ও পরে ব্রিটিশ আধিপত্যের জন্য আমাদের শহরটি বেশ বিখ্যাত । আমাদের পাড়াটি বেশ পুরানো । নিকটেই জমিদার বাড়ী । ছাদে উঠলে ওদের ভাঙা ছাদ দেখা যেত । জমিদারটি এককালে বেশ প্রথিতযশা ছিলেন ।জমিদার বাড়ী ছাড়াও তাদের জ্ঞাতিগুষ্টির বেশ কয়েকটা বড় বড় বাড়ী আশেপাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল । আমি যখন সেসব বাড়ী দেখেছি ।প্রত্যেকেটি ভগ্নপ্রায়,। আমাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের পথে এরকম একটি বাড়ী ছিল । ভগ্নদশা । বিরাট জায়গা জুড়ে দুমহলা কি তিন মহলা বাড়ী হবে । রঙ ওঠা দেওয়াল , ঝুলে পড়া জানলা দরজা । প্রধান গেট না থাকলেও গেটের ভাঙা স্তম্ভের ওপর মাথা ভাঙা এক সিংহ জমিদারের আভিজাত্যের রেস রাখার চেষ্টা করত ।বাড়ীর সামনের বিরাট বাগানটী ছিল পাড়ার ছেলেদের ফুটবল খেলার মাঠ । পাশে পুকুর ।বাড়ীর মালিক কে জানতাম না । কিছু পরিবারকে থাকতে দেখতাম । শুনতাম ওনারা ভাড়াটে । রাতে ঐ বাড়ির আশেপাশে খুব একটা কেঊ যেত না ।সবাই বলত সাদা শাড়ী পরে এক মহিলা নাকি থালাবাসন নিয়ে পুকুরঘাটে আসে । তার পায়ের পাতা ছাড়া বাকী অবয়ব দেখা যায় । আসপাসের বাড়ীর লোকজন গভীররাতে নাচঘর থেকে ভেসে আসা ঘুঙুরের শব্দ শোনে । একদিন আমাদের দাসুদা ঝমঝমে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ঐ বাড়ীর বারান্দায় উঠেছিলেন । হঠাত দেখে জানলা দিয়ে এক মহিলা ডাকছে । দাসুদা ভেতরে গিয়ে বসেন ।মহিলা এক কাপ চা দিয়ে আসছি বলে কোথায় চলে গেলেন , আর আসার নাম নেই। দাসুদা হঠাত শোনেন কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ । কৌতূহল বশত পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেড়িয়ে এগোতে এগোতে উঠে পড়েন ঠাকুরদালানে । ধূপধুনোর গন্ধে ম ম করছে চারিদিক। মূল মন্দিরের ভেজান দরজা একটু ঠেলতেই ফাঁক হয়ে যায় । দেখেন একজন মহিলা চামর দুলিয়ে ঠাকুরের আরতি করছেন । ঘর ভর্তি ধোঁয়া থাকায় মানুষটিকে ঠাওর করতে পারেন না । ভাল করে বোঝার জন্য দরজার পাল্লাটা যেই খুলতে যান । এমন সময় কোথা থেকে এক গোঁফওলা দারোয়ান এসে ওনাকে এই মারে তো সেই মারে । এই দারোয়ানকে কিন্তু পাড়ায় কোন দিন দেখেননি দাসু দা । সে যাত্রায় কোন মতে পালিয়ে বাঁচেন দাসুদা । সবাই বলত ঐ বাড়ীতে ভুত আছে । মিষ্টির দোকান যেতে হলে ভুতের বাড়ীর সামনে দিয়েই যেতে হত । ফলে সন্ধ্যেবেলা ঠাকুমা মিষ্টি আনতে বললেই হৃৎকম্প শুরু হয়ে যেত। কোন মতে দৌড়ে বাড়িটি পেরিয়ে যেতাম । আমাদের কাজের দিদি আবার পাড়ার গেজেট । তার ঝুলিতে নিত্যনুতন গল্প থাকত । একদিন চোখ বড় বড় করে ঠাকুমাকে শোনাল ঐ ভুতের বাড়িতে নাকি গুপ্ত সুড়ঙ্গ আছে । একটি গেছে নদীর ঘাটে অন্যটি রেল স্টেশনে । বাড়ীটি যবে তৈরি হয়েছিল সেসময় রেল আমাদের শহরে আসেনি । তবে সুড়ঙ্গ স্টেশন অবধি কেন আমার মাথায় ঢোকেনি ।উত্তর দেওয়ার লোক নেই । ঐ ভুতের বাড়ীর গিন্নীর নাকি খুব গহনা পরার শখ ছিল । আরও শুনলাম বাড়ীর মালিক প্রচুর গুপ্তধন মাটির নিচে পুতে রেখে গেছেন । গিন্নী গহনা পরে বাপের বাড়ী যাবার পথে ডাকাতের হাতে প্রান দেন । তারপর থেকে রোজ রাতে ঐ বাড়ীতে এসে গহনা খোঁজে । আস্তে আস্তে বাড়িটি বেশ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল আমাদের কাছে। আর মজার বেপার হল আগে কেউ মাঝে মধ্যে ভুতের সাক্ষাত পেত । কিন্তু দিনে দিনে ভুত অহরহ হানা দিতে লাগল । কেউ কেউ দিনের বেলাও ভুত দেখতে লাগল । সুতরাং বেশীরভাগ লোক ঐ বাড়ী থেকে দূরেই থাকত । একদিন সকালে কাজের দিদি রাম নাম জপতে জপতে হন্তদন্ত হয়ে এসে জানাল - আজ কাজে আসার সময় ভুতের বাড়ীর সামনে ইলেক্ট্রিকের তারে একটি হাত ঝুলতে দেখেছে । সে হাত নাকি আঙ্গুল নেড়ে ওকে ডাকছিল । ওটা যে ভুতের হাত তাতে কোন সন্দেহ নেই । বেলা বাড়ার সাথে সাথে পাড়ায় হুলুস্থুল পরে গেল । কারন ভুতের হাতটী অদৃশ্য না হয়ে তারে ঝুলছেই । কিছুক্ষন পরে পুলিশ এল । খানাতল্লাশি শুরু হল ভুতের বাড়ীর। জানা গেল কিছু নকশাল ছেলে বেশকিছুদিন ধরে ঐ পোড়ো বাড়ীতে আস্তানা নিয়েছিল । তারা লুকিয়ে বোমা বানাচ্ছিল । অসাবধানে একজনের হাতে বোমা ফেটে যায় আর হাতটিও উরে যায় । ওরাই ভুতের গল্প রটিয়ে বেড়াত । যাতে ঐ বাড়ীর কাছে কেউ না আসে । ------------------------------------------------------------------
মনোজ ভট্টাচার্য
যে বৃদ্ধাবাস হয় নি ! সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার শেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অশ্ব উপস্থিত এখন - অন্তিম যাত্রার অপেক্ষায় ! নিজেদের ক্লান্তি, অক্ষমতা ও একাকীত্ব কাটাতে আমাদের খোঁজ পড়লো বৃদ্ধাবাসের ! বেশ কয়েকটা বৃদ্ধাবাসে গেলাম ! প্রধানত উত্তর কলকাতায় ! এখানে বলে রাখি – আমরা বেশ কয়েক বছর ধরেই মাঝে মাঝে নানান বৃদ্ধাবাসে গেছি ও যাই ! ঘাটালে গেছি – কল্যাণীতে গেছি – কোলাঘাটে গেছি কলকাতার মধ্যেও গেছি কয়েকটা বৃদ্ধাবাসে – বলা ভালো বৃদ্ধাশ্রমে ! - যাই দেখতে মুলত আমাদের মতো সংসারের উদ্বৃত্ত মানুষেরা কোথায় কিভাবে আছে – চাক্ষুষ করা ! এককালে সংসারের কত্রী বা কর্তা – যারা নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী নিজস্ব রাজ্য-পাট চালাতেন ! - এখন তাঁদের চাহিদা একেবারে শূন্য হয়ে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছেন ! কাদের আশ্রয় আছেন ! আমার মাসী ছিলেন খুব ধনী ! সংসারের ঝামেলা এড়াতে তিনি গিয়ে থাকতেন বিড়লার এক বৃদ্ধাবাসে ! তখনকার দিনে ধনীদের একটা বিশ্রামাগার ! সে রকম বৃদ্ধাবাস তো চোখে পড়েনা এখন ! নাকি আমরা সেখানে গিয়ে পৌছতেই পারিনি এখনও ! অবশ্য গিয়ে পৌঁছেছিলাম – স্নেহদিয়া নামে এক ফাইভ স্টার বৃদ্ধাবাস হোটেলে ! পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্যে ও অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা এই ফাইভ স্টার বৃদ্ধাবাস – মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে ! সে যাইহোক সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান-ডেস্কে পৌঁছে দেখি যিনি আছেন সেখানে – তিনি যথেষ্ট গপ্পুরে বা গল্পবাজ ! বিশেষ আমরা উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের শুনে ভালমত গল্পে জমে গেলেন ! – হ্যাঁ – কিন্তু আসল ফিল্ম এখনও শুরুই হয় নি ! – ন-তলা ও দশ-তলায় ঘর দেখাল ! সে ঘর মানে হোটেলের সুইট ! বেডরুমের আগে একটা যায়গা – আমরা যাকে লিভিং রুম বলি – বেশ বড় ! সেখানে এসি – টিভি – ইলেকট্রিক কেটলি – মানে সব রকম ইত্যাদি আছে ! কিন্তু ফ্রিজ নেই ! আর সুইট থেকে বেরিয়েই লম্বা বারাণ্ডা – প্রায় ফুটবল খেলা যায় ! কিন্তু ফুটবল কেন – টেবিল-টেনিসও খেলা যাবে না ! প্রত্যেক সুইটের সামনে টেবিল ও চেয়ার পাতা – খাওয়া বা গল্প করা বই পড়া ! বইও আছে বুক-শেলফে ! আর দেওয়াল জুড়ে পুরনো দেশী বিদেশী চিত্র তারকাদের বড় বড় বাঁধানো ছবি ! আর জানলার সামনে দাঁড়ালে – ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করবে মেঘপরীদের সাথে ! পাঁচতলার বারান্দাটা বিরাট – অনেকটা চৌরঙ্গীর গ্র্যান্ড হোটেলের বারান্দার দ্বিগুণ ! প্রত্যেক ফ্লোরে একজন করে মহিলা ইউনিফর্ম পড়ে ডিউটি দিচ্ছে ! কোন দরকার হলেই – হাজির – ‘ইয়েস ম্যম’ ! চিকিৎসার বন্দোবস্ত ! ও হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স – নিজের খরচায় ! – এক কাপ চা খেতে হলেও – ‘ইয়েস ম্যম’ নিয়ে আসবে ! বৈভব আছে – হয়ত সুখও ! কিন্তু বড়ই নিঃসঙ্গ ! কোন কথা বলার লোক নেই – গল্প করার জন নেই ! বাড়িতেও দুজন – এখানেও দুজন ! – সেই পাতা ঝরার দিনের গল্প ! – নিঃসঙ্গতা কাটাতে হলে সামনেই এদের একটা বিনোদন স্থান আছে ! প্রত্যেক সপ্তাহে কিছু না কিছ প্রোগ্রাম হয়ই ! ধারে কাছে কোন দোকান বা চায়ের ঠেক দেখা গেল না ! দাঁড়াও পথিকবর – তিষ্ঠ ক্ষণকাল - - ! বৃদ্ধাবাসের ছবি দেখানো হয়েছে সিরিয়ালে – সেটাই খুঁজতে গিয়ে দেখি – সেটা অনেক ক্ষেত্রেই অলীক ! মোটামুটি সব বৃদ্ধাবাসের চেহারা বড়ই করুণ ! বৃদ্ধাশ্রম বলে বটে ! ছোট ছোট ঘর – তার মধ্যে দুজন বা তারও বেশি মানুষকে থাকতে দেওয়া হয় ! আবাসিকদের শরীর-স্বাস্থ্য খুব একটা ইম্প্রেসিভ নয় ! আমাদের এক বন্ধু স্বেচ্ছায় এক বৃদ্ধাবাসে আছেন – সেখানে আমাদের যাতায়াত আছে – মোটামুটি ভালোই ! খাওয়া দাওয়া চিকিৎসা পরিচারক-পরিচারিকা লভ্য ! আর দক্ষিণাও মধ্যবিত্ত-সুলভ ! তাই হয়ত সেখানেই ঠেক নিতে হবে ! একটা বৃদ্ধাবাসের ঠিকানা পেলাম – নাম সুতানুটি ! বোধয় কেস্টপুর খালের অঞ্চলে ! সেখানে ফোন করে জানলাম – যদিও সেটা হয়ে যাবার কথা ছিল – ২০২০ সালে ! কিন্তু করোনা-কারনে সেটা এখনও শুরু করাও যায় নি ! – তবু যদি একবার অঞ্চল ও অবস্থানটা দেখা যেত ! তো অতি রসিক এক ভদ্রলোক জানালেন – যে বৃদ্ধাবাস হয়ই নি – সেটা দেখাব কি করে! অর্থাৎ কিনা যে নদী নেই – তার ওপর সেতু ! সত্যিই তো – যে বৃদ্ধাবাস হয়ই নি – আমাদের জন্যে ! মনোজ ভট্টাচার্য
শিবাংশু
'....রাত এগারোটায় যখন পাশাপাশি উষ্ণতায় ঘিরে বসে শুনছিলাম বাউলগান, কে বানালে এমন ঘর, ধন্য কারিগর .... মাথাতে ঘুরছিলো সেই প্রশ্ন, কার ঘর ? কে কারিগর? ঘর কে গড়ে কেই বা ভাঙে? কার ঘর, কে থাকে? হঠাৎ কানে কানে প্রশ্ন এলো, একটা কথা বলবো, হাসবে নাতো? বলো ... আমার যদি সারা জীবন এভাবে তোমার সঙ্গে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়, তুমি কি না বলবে ... ? প্রশ্নের উত্তরে চুপ থাকা বোধ হয় আমার ধাতে নেই, কিছু হয়তো বলা যেতো। কিন্তু ঐ চোখ আর সারাদিনের শ্রান্তিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও ভাষা আমার জোগালো না। প্রেমের দেখা দেখে যখন, চোখ ভেসে যায় চোখের জলে ... চোখে জল ছিলো কি? কে জানে ছিলো বোধ হয়, এতোদিন পরে আর মনে নেই....' পুরোনো একটা লেখা আমার। এভাবেই । কবি আর বেহাগ আর অনেক ফেলে আসা সময়ের বৃত্ত। মনে পড়লো ........... (শুনতে ইচ্ছে হলে ইয়ারফোন ইত্যাদির অনুরোধ রইলো ) https://www.youtube.com/watch?v=m4ItuJ_vBSo&t=34s
মনোজ ভট্টাচার্য
মননে সৌমিত্র ! ছোটবেলায় আমরা খুব ইংরিজি সিনেমা দেখতাম ! তাই আমাদের মধ্যে একটা ইংরিজি সিনেমার অনুকরনীয় ভাব ছিলই । - তাই একটু বড় হওয়ার পর বাংলা সিনেমার নায়কদের কিরকম আলুভাতে-মার্কা মনে হতো ! তাই তার মধ্যেই যদি কেউ ঘাড় সোজা করে কথা বলত – বেশ একটা পুরুষ বলে মনে হতো ! – এই কথায় কেউ যেন রাগ করবেন না ! এটা আমার ত্রুটি বলে ধরবেন ! স্কুল থেকেই কবিতা বা গল্প লেখার অভ্যেস ছিল । সে কবিতা কেউ ছাপুক বা না-ছাপুক, কেউ পড়ুক বা না-পড়ুক – কি আসতো-যেত ! এইভাবেই আমি একদা বাঞ্ছারাম অক্রুর লেনে এক্ষণের – নির্মাল্য আচার্যের বাড়ি যেতাম । সেখানে কিন্তু সৌমিত্রকে দেখিনি ! – কিন্তু তাঁকে আমরা দেখতাম – প্রায় বিকেলের পরে – কফি হাউসে । সিঁড়ি দিয়ে উঠেই – ঠিক উল্টোদিকে – কাঠের পার্টিসানের গায়ে – তখন কারুকে চিনলেও আজ আর মনে পরে না ! – তখন সৌমিত্র দিল্লির যুব উৎসব থেকে ফিরেছেন । - অপুর সংসার দেখেছি – প্রায় ফাঁকা হলে ! পরের বছরে কেয়া দিল্লিতে গেছিলো । – কেয়াই আমাদের ওনার পরিচয় দিল । অপরাজিত সিনেমা করার জন্যে এসেছিলেন । সত্যজিত রায় নাকি অনেকের সঙ্গেই ওনার সম্বন্ধে বলেছেন ওনার পরের ছবি অপুর সংসারে - অপু ! – তখন তো সৌমিত্রর বেশ কবি কবি চেহারা ! – আমাদের সকলেরই আদর্শ চেহারা ! পরিচিত হলেন বটে অপুর নামে – কিন্তু পরে উনি হয়ে গেলেন ময়ুরবাহন ! - বান্দার বাচ্ছা ! – ঘোড়ার পিঠে চড়ে – চাবুকের মতো চেহারা – একদম সোজাসুজি রাধামোহনের সামনা-সামনি - বললেন ! একী – স্টুয়ার্ট গ্রেঞ্জার এসে গেল কি করে ! সিনেমার নাম তো সবাই জানেন – ঝিন্দের বন্দী ! আমরা সত্যিই চমকে গেছিলাম ! আবার দেখলাম – ক্ষুধিত পাষানে – তফাৎ যাও ! – শুনেছি অনেকে নাকি ভির্মি খেয়েছিল হলের মধ্যে ! - পরে এও দেখলাম – ফাইট কোনি - ফাইট ! এগুলো হল সব চরিত্র – বিভিন্ন চরিত্রের অভিনয় ! কিন্তু এগুলোই মাত্র সৌমিত্র নয় ! সৌমিত্র হলেন এক বহুমুখী প্রতিভার নাম ! – সিনেমা যেমন ভালো চরিত্র করেছিলেন – তেমনি আবার অনেক ফালতু অভিনয়ও করতে হয়েছিল ! – এই প্রসঙ্গে বলি – একটা ইংরিজি প্রোগ্রাম – নাম ছিল বৃক্ষ – আলোচনা হচ্ছিল । তাতে সৌমিত্র বলেছিলেন – সম্প্রতি যেসব সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন – সেগুলো কোন অভিনয়ই নয় ! – ওম পুরীর কথায় – ডাল রোটির ধান্দা ! একজন অভিনেতার একটাও মনোমত চরিত্র করতে না পাওয়ার অর্থ যে কী – তা আমরা পরবর্তীকালে খুব দেখেছি ! সৌমিত্রর মুল লক্ষ্য ছিল – নাটক ! অবশ্যই কবিতার পর – নাটক ! – কত রকমের চরিত্রে উনি অভিনয় করেছেন ! সব নাটক তো আমার দেখাই হয় নি ! কিন্তু কিং লীয়র ! – ব্রাত্য বসুরা যখন মিনার্ভা হল থেকে লীয়ারকে বার করে দিল – তখন কিং লীয়ারের রবীন্দ্র সদন নেওয়া ছাড়া গতি রইল না ! অগত্যা আমাদেরও কত বেশি দামে রাজাকে দেখতে হল ! এর পর যতগুলো শো হয়েছিল – সব কিন্তু হাউজ ফুল ! কোন অভিনেতার সঙ্গে কোন অভিনেতার তুলনা করার চেয়ে বোকামি কিছু নেই ! তবু ক্ষেত্র-বিশেষে কিছু প্রশ্ন এসেই যায় ! যদিও সৌমিত্রবাবু শিশিরবাবুকে গুরু মানতেন – গুরু তো উনি বটেনই ! কিন্তু আমার মনে হয় সেই সময়কালে অভিনয়ের যে একটা বিশেষ স্টাইল ছিল – যেটা কিন্তু সৌমিত্র-কালে রইল না ! তাই দর্শকের কাছে একটা স্বাতন্ত্র্য এসে গিয়েছিল তাঁর ! যেমন মার্লোন ব্র্যান্ডো – তাঁর নিজস্বতা নিয়ে অভিনয় করতেন – তাতে তো দর্শকের কোন অসুবিধে ছিল না ! – তাই সৌমিত্রকেও বলা যেতে পারে – তিনি একাই একক ! তাছাড়া তাকেও পরিচালকদের ব্যুহ ভেদ করে সেই ধারা চালাতে হয়েছে ! লড়াই তো সৌমিত্রকে করতে হয়েছেই ! যেমন পারিপার্শ্বিক বামপন্থী রাজনীতি, তেমনি নিজের স্বাস্থ্য, সংসার, ব্যক্তিগত অনেক অসুবিধে – সব লড়াই করতে করতে নিজেকে প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছেন ! প্রথম দিকে তো সরকারি খেতাব প্রত্যাখানও করেছেন ! তাই আমি এই লেখায় সৌমিত্রর নাম দিলাম বিরামহীন লড়াই ! মনোজ ফেস বুক থেকে পুন-প্রকাশ !
শিবাংশু
আমার প্রজন্মের বাঙালিদের কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একটি নৈসর্গিক মাত্রা। তিনি কাজ শুরু করেছিলেন আমি যে বছরে জন্মেছি, ঠিক সেই সময়। 'বাঙালিয়ানা' শব্দটি এই প্রজন্মের কাছে হয়তো প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কিন্তু আমরা যখন থেকে পৃথিবীকে চিনতে শিখেছি, বাঙালিয়ানা একটা অবশ্য অনুসরণীয় ছাঁচ ছিলো আমাদের জন্য। আমরা সাবেক প্রবাসী বাঙালি। তাই বাঙালিয়ানার প্রতি টানটা বেশি ছিলো আমাদের। তা ছিলো এক ধরনের যাপন-নির্দেশ। এক ধরনের মূল্যবোধের দিশা। 'জীবন লইয়া কী করিব' তার সংলিপ্ত সমীকরণ। ১৮৫০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত সময়কালে বাঙালি জাতির সামগ্রিক জীবনে যা কিছু ইতিবাচক উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা, হিন্দু কলেজ থেকে দেশভাগ, সেগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছিলো বেশ কিছু আকাশ ছোঁয়া মানুষের বেঁচে থাকার মানচিত্রকে অনুসরণ করে। এই সব মানুষরা ছিলেন মেধাবান, আত্মসম্মানী, সাহসী, সৃষ্টিশীল, প্রতিবাদী, বিবেকী, বিনয়ী, শিল্পচেতন সময়ের প্রহরী। এই মানুষগুলিই তৈরি করে দিয়েছিলেন 'বাঙালিয়ানা' নামের কিছু বিমূর্ত ধারণা। সত্যি কথা বলতে কি 'রেনেসাঁস' বলতে যে মানসিকতাটি বাঙালির প্রিয়তম ব্যসন, তারই শিকড় ছিলো ঐ বোধটিতে। মেধাবী, উদার, মুক্তমন, উদ্যমী, মানবিক বাঙালিদের প্রজন্মগুলি আমাদের আত্মপরিচয় তৈরি করে দিয়েছিলো। সৌমিত্র ছিলেন দিগঞ্চলে মিলিয়ে যাওয়া সেই সব মানুষের শেষ প্রতিনিধিদের একজন। গত শতকের পাঁচের দশকে তাঁদের উত্তরগামিনী ছায়ার মতো নিজেকে প্রস্তুত করে আসরে নেমেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছয় দশকেরও বেশি দিন দীর্ঘ সৃজনশীল পথ চলায় নিজেকে প্রকাশ করে গেছেন অসংখ্য মাত্রায়। অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, কবি, আবৃত্তিকার, সম্পাদক, ছবি-আঁকিয়ে, প্রতিবাদী মিছিলের মুখ। এসবের থেকেও বড়ো ব্যাপার হলো, এই মাত্রার একজন কৃতী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে তাঁর আবেদন একজন ঘরের মানুষের মতো। ঠিক যেমন তাঁর পূর্বসূরিরা কোনও রকম রক্ত-সম্পর্ক ছাড়াই আমাদের ভিতর বসত করে ফেলেন অবলীলায়। মানুষের সমাজে তাঁর কীর্তি, সাফল্য, সীমাবদ্ধতা, গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। বৃহত্তর বিশ্বে আরও বহুদিন হবে । এই মুহূর্তে যখন তাঁর পার্থিব শরীরের অবশেষ অগ্নিদেবতা মিলিয়ে নিচ্ছেন নিজের অঙ্গে । সকল দাহ জুড়িয়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে দাহের শান্তিকল্যাণে, গুরুর দৌলতে পাওয়া দু-চারটে শব্দের ফুল তাঁর জন্য রেখে দিলুম এইখানে, https://www.youtube.com/watch?v=D6Mp7SQK8yI&fbclid=IwAR1hFgEKEJL3Ljj9ogJYdAtNT05JEmSmTFQe_q4j38XwqzM1qcAHbbP7kPE
শিবাংশু
শুভ বিজয়া, একবার বন্ধুদের বলেছিলুম, যদি কখনও সিনেমা তৈরি করি, তবে সেটা অতুলপ্রসাদের জীবনকাহিনীর ভিত্তিতে করার কথা ভাববো। একালের একজন মানুষের যে এমন মহাকাব্যিক নায়কদের মতো ট্র্যাজেডি আতুর যাপন থাকতে পারে, তা না জানলে বোঝা যাবেনা। আজীবন 'এক-নারী' অনুগত একজন খ্যাতিমান শিল্পী, স্রষ্টা, বৃত্তিজীবী, আদৃত মানুষ অতুলপ্রসাদ সেন। কিন্তু তিনি আমৃত্যু জীবনের ‘একমাত্র’ নারীর থেকে সামান্য শান্তির আকাঙ্খা, 'দুয়েক মুহূর্তের ভিক্ষা' পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অশান্তিকাতর জীবন থেকে অব্যাহতি পেতে আকুল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। লখনউয়ে তুমুল সফল আইন ব্যবসা ছেড়ে তিনি কলকাতায় ফিরে এলেন ১৯১৫ সালে। কলকাতায় সবার কাছে আদৃত হয়েও আবার পারিবারিক টানাপোড়েনের চাপে ১৯১৭ সালে ফিরে গেলেন লখনউ । ১৯২৩ সালে তাঁর গুরু রবীন্দ্রনাথ লখনউ গেলেন অতুলপ্রসাদের আতিথ্য নিয়ে। তাঁর আগমনের খবর পেয়ে বহুদিন পর স্ত্রী হেমকুসুম পুত্রকে নিয়ে ‘ফিরে এলেন’ অতুলপ্রসাদের কাছে । উচ্ছ্বসিত অতুলপ্রসাদের মনে হলো তাঁর দুঃখের দিন শেষ হলো বুঝি। একসঙ্গে গুরু এবং সঙ্গিনী দুজনেই তাঁর গৃহে এসেছেন। পরম তৃপ্তিতে তিনি গুরুকে শোনালেন অনেক গান। গুরুও মুগ্ধ। গুরু যাবেন বোম্বাই। তাঁকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এসে দেখেন হেমকুসুম আবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। গান ছাড়া অতুলপ্রসাদের জীবনে আর কোনও সম্বল বাকি ছিলো না। এই ঘটনার কিছু দিন পরেই, ১৯২৪ সালের মে'মাসে পেলেন নিদারুণ শোক। পরমপ্রিয় ভাগনি বুলবুলের অকস্মাৎ মৃত্যু তাঁকে অবসন্ন করে দিয়েছিলো। গভীর শোকের সেই মুহূর্তে রচনা করেছিলেন গানটি। শুনিয়ে ছিলেন প্রিয় মানুষ দিলীপকুমার রায়কে। গাইতে গাইতে একটু থেমে বলেছিলেন, 'দিলীপ, এ গানটি কিন্তু যার তার কাছে গেয়ো না; এ গানটি আমার বড় ব্যথার দিনে লেখা...আমার জীবনের এক দারুণ দুঃখের সময় - যখন মনে হয়েছিল - যাক সে কথা।' (সুরেলা- দিলীপকুমার রায়) বিজয়াদশমীর দিন মনে পড়লো গানটি। এক আশ্চর্য দশমী এবার। আগমনী ছাড়াই বিসর্জন যেন। দুঃখের দিন মানে তো তাইই। সেই মিশ্র ভৈরবী রাগিণী। অতুলপ্রসাদের গুরু যা নিয়ে বার বার সাজিয়ে গেছেন তাঁর অপার সৃষ্টির সাম্রাজ্য। অতুলপ্রসাদের গানকে যে ভাবে জেনেছি, সে ভাবেই কিছু অক্ষম প্রয়াস। যাঁরা সময় নষ্ট করে শুনবেন, কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে নিলে বাধিত হবো। https://www.youtube.com/watch?v=_FHZ3uvwL1E&t=336s